কৃষি ও কৃষকদের উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়ে ক্ষুধা ও দারিদ্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে নানাবিধ প্রতিকূলতার মধ্যেই আর্ন্তজাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনার পাশাপাশি কৃষি ক্ষেত্রে বাস্তব লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে চলছে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়(সিকৃবি)।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষ শিক্ষক ও গবেষকগণ শীতকালের ফসল গ্রীষ্মকালে চাষ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। মাছ, সবজি ও কবুতর একসাথে পালন করার একোয়াফোনিক্স পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। যা ব্যবহারের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূলতা মোকাবেলা সম্ভব হবে উপকূলীয় অঞ্চলের চাষীদের।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সিস্টেম (সাউরেস) দেশের চাহিদা,বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজ্ঞা ও মেধার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ১২৮ টি গবেষণা প্রকল্প সমাপ্ত করেছে।
ইতোমধ্যে উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. মো. শহীদুল ইসলাম সারা বছর চাষোপযোগী সিকৃবি সিম-১ এবং সিকৃবি সিম-২ নামে দু’টি সিমের জাত উদ্ভাবন করেছেন।
এছাড়া ক্যাপসিকাম ও ব্রোকল্রি লাগসই চাষ প্রযুক্তিসহ টমেটোর উচ্চতাপ সহিষ্ণু দু’টি জাত উদ্ভাবন করেছেন যা মুক্তায়নের অপেক্ষায় আছে। তরুণ বিজ্ঞানী সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. সাখাওয়াত হোসেন মাছের ফাংশনাল ফিড উন্নয়ন সম্পর্কিত গবেষণা কাজ শেষ করেছেন।
ফাংশনাল ফিড ব্যবহারের ফলে মাছের পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ মাছের সামগ্রিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. মো. আবুল কাশেম, মাইক্রোবায়োলজি ও ইমিউনোলজি বিভাগের প্রফেসর ড. মো. আবু বকর সিদ্দিক এবং উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মাৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল ইসলাম বিস্তীর্ণ হাওর অঞ্চলে সুষম সারের ব্যবহার, উচ্চফলনশীল বোরো ধানের চারা, উন্নত কৃষি প্রযুক্তি এবং বিভিন্ন ধরনের সেচ পদ্ধতি প্রয়োগ করে বোরো ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ হাওর অঞ্চলের জলাশয়ে অধিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, স্বল্প গভীরতায় সহনশীল, উচ্চ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন এবং উচ্চ বাজারমূল্যে দ্রুত বর্ধনশীল মাছের চাষাবাদ পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছেন।
ফার্মাকোলজি বিভাগের প্রফেসর ড. মো. ছিদ্দিকুল ইসলাম হাঁস-মুরগি, ছাগল, গিনিপিগ ও ইঁদুরের উপর আর্সেনিকের প্রভাব ও তার প্রতিরোধের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন যা মানবদেহে আর্সেনিক প্রভাবে সৃষ্ট রোগের প্রতিরোধে সক্ষম।
ছাগলের ব্যাকটরিয়াজনিত রোগ এন্টারোটক্সিমিয়ার প্রতিষেধক টিকা উদ্ভাবন করেছেন মাইক্রোবায়োলজি ও ইমিউনোলজি বিভাগের প্রফেসর ড. এটিএম মাহবুব-ই-ইলাহী। যা দেশি জাতের কালো ছাগলের আকস্মিক মৃত্যুরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ফসল উদ্ভিদ বিজ্ঞান ও চা উৎপাদন প্রযুক্তি বিভাগের প্রফেসর ড. এ.এফ.এম সাইফুল ইসলাম মিষ্টি আলু ও ঢ়েঁড়সের লাগসই চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন।
কৃষিতত্ত্ব ও হাওর কৃষি বিভাগের প্রফেসর ড. মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস স্থানীয় প্রজাতির সুগন্ধি চাল উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়ে গবেষণা করছেন।
এছাড়াও মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের প্রফেসর ড. মৃত্যুঞ্জয় কুন্ড ও সহযোগী অধ্যাপক ড. নির্মল চন্দ্র রায় হাওর অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য রক্ষাসহ জেলেদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি শিক্ষার্থী ও দক্ষ শিক্ষকগণ শিক্ষা ও গবেষণায় অবদানের জন্য রাষ্টপতি ও প্রধানমন্ত্রি স্বর্ণপদকসহ পদক প্রাপ্ত হয়েছেন। প্রাণিসম্পদ বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণার জন্য বাংলাদেশ একাডেমি অব এগ্রিকালচার কর্তৃক গোল্ড মেডেল পুরস্কার পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মো. গোলাম শাহি আলম ।
ভেটেরিনারি, এনিম্যাল ও বায়োমেডিকেল সায়েন্সেস অনুষদের প্রফেসর ড. মোঃ মাছুদুর রহমান যক্ষা রোগের মলিকুলার ডায়াগনস্টিক পদ্ধতি আবিষ্কার করায় বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সেরা গবেষক হিসেবে পুরস্কার লাভসহ ভারতের ভেনাস ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন কর্তৃক আউটস্ট্যান্ডিং সায়েন্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।
নবায়ন যোগ্য জীবাশ্ম জ্বালানী বিষয়ে গবেষণার জন্য সহযোগী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ রাশেদ আল মামুন সেরা গবেষক হিসেবে ওআইসি দেশসমূহের প্রাতিষ্ঠানিক কিংডম অব সৌদি এরাবিয়া পুরস্কার লাভ করেছেন।
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সামগ্রিক কৃষি ব্যবস্থাকে উন্নত করতে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় একটি সম্ভাবনার নাম। সিলেটের লালচে মাটির গুণগত মান দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে ভিন্নতর। আবার বৃহত্তর সিলেটে রয়েছে হাজার হাজার একর অনাবাদি উঁচু-নিচু পাহাড়ি অসমতল ভূমি। আছে হাওর নামের বিস্তীর্ণ জলাশয়। অপার সম্ভাবনাময় এসব প্রাকৃতিক সম্পদ গবেষণার মাধ্যমে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার আওতায় আনার জন্য ইতিমধ্যে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬টি অনুষদ সাফল্যের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদ এবং মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ থেকে গ্র্যাজুয়েট হিসেবে ৬টি করে ১২টি ব্যাচ বের হয়েছে। ভেটেরিনারি, এনিম্যাল ও বায়োমেডিকেল সায়েন্সেস অনুষদ থেকে ১৮টি ব্যাচ বেরিয়ে গেছে। কৃষি অর্থনীতি ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ থেকে বের হয়েছে ৪টি ব্যাচ এবং কৃষি প্রকৌশল ও কারিগরি অনুষদ থেকে বের হয়েছে ২ টি ব্যাচ। এরা সবাই এখন স্ব-স্ব ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ উজ্জ্বল করার পাশাপাশি বাংলাদেশের কৃষির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
নিত্য নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও জাতির কল্যাণে হস্তান্তরেরে উদ্দেশ্যে ৬ টি অনুষদের ৪৭ টি বিভাগে বর্তমানে ২০০০ এর অধিক দেশী-বিদেশী শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত আছে।
সিকৃবির ভিসি প্রফেসর ড. মোঃ গোলাম শাহি আলম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার পদ্ধতিতে শিক্ষা দানের মাধ্যমে নির্দিষ্ট দিনে পরীক্ষা সম্পন্ন করা হচ্ছে। এছাড়া ক্যাম্পাসের শিক্ষার মনোরম পরিবেশ রাজনীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত হওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে একদিনের জন্যও ক্যাম্পাস অনির্ধারিত বন্ধ থাকেনি। সেশনজট মুক্ত এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা ও গবেষণার উন্নতমান দিন দিন আর্কষণ করছে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের। ফলে দিন দিন বেড়ে চলছে ক্যাম্পাসে মেধাবীদের কোলাহল, পাশাপাশি বিদেশী শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে।
কৃষিই কৃষ্টি’ কৃষিই ঐতিহ্য ও প্রাচুর্য্যের সম্ভার। কৃষির সমৃদ্ধিই বাংলাদেশের সমৃদ্ধি, কৃষি এদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। উন্নত মান সম্পন্ন উচ্চতর কৃষি শিক্ষা ও গবেষণা ব্যবস্থা নিশ্চয়তা বিধানের মাধ্যমে দেশের কৃষি উন্নয়নে গুরু দায়িত্ব বহনে সক্ষম তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান সম্পন্ন দক্ষ কৃষিবিদ, কৃষিবিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ তৈরি করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ২০০৬ সালে দেশের উত্তরপূর্ব কোণে প্রকৃতির এক অপরূপ লীলাভূমি সিলেট শহরে ছোট বড় টিলা বেষ্টিত ছায়াসুনিবিড় প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
আজ কৃষি শিক্ষা ও গবেষণার দিশারীতে পরিণত হয়েছে। আধুনিক কৃষি শিক্ষা ও প্রায়োগিক গবেষণায় সুযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষি উন্নয়নে দক্ষ জনবল সৃষ্টি, দেশের ক্রমবর্ধমান জনগনের খাদ্যে চাহিদা পূরণ, কৃষি ব্যবস্থায় প্রায়োগিক কৃষি শিক্ষার ব্যবহার, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কান্ডারির ভূমিকা পালন করছে সিকৃবি।
বিশ্ববিদ্যালয়টি ছোট বড় টিলা বেষ্টিত ৫০ একরের উপর অবস্থিত, যা একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য খুবই অপ্রতুল। সীমিত সুযোগ সুবিধার মধ্যেই পূর্ণ উদ্যমে চলছে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে প্রতিকূল আবহাওয়া ও পরিবেশে উৎপাদনক্ষম নতুন নতুন কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তি ও প্রকরন উদ্ভাবন এবং জাত সৃষ্টির মাধ্যমে সিকৃবির শিক্ষক ও গবেষকরা হাওর-বাওড়, জলাশয় যা মাৎস্য উৎপাদনের জন্য উপযোগী এবং ফসল উৎপাদনের জন্য অবারিত ও পতিত জমি ব্যবহার করে তাদের লব্ধ জ্ঞানের মাধ্যমে কৃষি শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণা দ্বারা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মূল ভূমিকা পালন করছে।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে বিভিন্ন বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক সংস্থার সাথে শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। যার ফলে শিক্ষার্থীসহ শিক্ষক ও গবেষকগণ দেশে ও বিদেশে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত করতে পারছেন। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ও ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন এগিয়ে চলছে। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী ভবন, ভেটেরিনারি ক্লিনিক্স, ক্যাফেটেরিয়া ভবন, দ্বিতীয় ছাত্রী হল, পঞ্চম ছাত্র হল, ও কেন্দ্রীয় অডিটরিয়াম, কৃষি অর্থনীতি ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ ভবনের নির্মান কাজ চলমান রয়েছে।
নবীনতম এ বিশ্ববিদ্যালয়টি দেশের দ্বিতীয় পূর্ণাঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হলেও জমি স্বল্পতায় খামার ব্যবস্থাপনা অপ্রতুল হওয়ায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে। প্রয়োজনের তুলনায় আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রায়োগিক শিক্ষার যথাযথ ব্যবহার করতে পারছে না। অথচ বিশ্ববিদ্যালেয়ের পার্শ্ববর্তী সরকারি ছাগল উন্নয়ন খামার, জেলা দুগ্ধ খামার এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভূক্ত করা হলে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে গবেষণা ও উৎপাদন আরও বেগবান করা সম্ভব হবে।
এ প্রসঙ্গে ভিসি প্রফেসর ড. মোঃ গোলাম শাহি আলম বলেন, শিক্ষার্থীদের গবেষণাগার, শ্রেণীকক্ষ ও আবাসিক ব্যবস্থার জন্য সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে তিনটি একাডেমিক ভবন, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের আবাসিক সুবিধা প্রদানের নিমিত্তে বিভিন্ন স্থাপনা, হেলথ কেয়ার সেন্টার, জিমনেশিয়াম, সেন্ট্রাল ল্যাবরেটরি, পরীক্ষার হল, মৎস্য খামার, আসবাবপত্র, আইসিটিসহ যন্ত্রপাতির সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।
লেখক : উপ পরিচালক, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
বিডিপ্রতিদিন/ ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৭/ ই জাহান