চট্টগ্রামে রেলওয়েতে এক প্রজ্ঞাপনে ১৯ শীর্ষ কর্মকর্তার রদবদল হয়েছে। দীর্ঘ বছর পরে হঠাৎ এতো বড় বদলী নিয়ে রেল অঙ্গনে নানা প্রশ্ন উঠেছে খোদ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝেই। গত ১৭ ডিসেম্বর হওয়া এই বদলী আদেশের ফলে রেলের শীর্ষ পদের কর্মকর্তাদের মধ্যে বদলীর আদেশের পর অন্যদের মাঝেও নানা আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। যে কোনো সময় আরও নতুন আদেশ আসছে কিনা সেই বিষয়ে কর্মক্ষেত্রে দায় সারাভাবে কাজ করছেন অনেকেই।
অনেকেই মন্তব্য করেছেন, এটি ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা সিন্ডিকেট করে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে রেলমন্ত্রী ও রেলের মহাপরিচালককে (ডিজি) বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে এসব বদলী করানো হয়েছে। এতে অনেকেই কয়েকটি পদে দায়িত্ব পালন করছেন অনেকেই বছরও পার করেননি। দায়িত্ব নিয়ে কিছু কর্মকৌশল সৃষ্টি করার আগেই সেই কৌশলী চক্রের স্বার্থেই এসব বদলী করা হয়েছে।
তবে ১৯ জনের আদেশের মধ্যে কয়েকটি পদের বদলী নিয়ে চরম হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে রেল অঙ্গনে। এসব নিয়ে দায়িত্বশীলরা ‘সরাসরি’ খতিয়ে দেখার প্রশ্নও তুলেছেন। কার, কোন স্বার্থে এসব বদলী এক সাথে করা হয়েছে। তাছাড়া ঊর্ধ্বতন কিছু কর্মকর্তা একটি সিন্ডিকেট তৈরি করতে এসব রদবদল করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে নিশ্চিত করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ শ্রমিক সংগঠনের নেতারা বলেছেন, রেলে রদবদল নিয়মিত ঘটনা হলেও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মো. আবদুর রহিম স্বাক্ষরিত এক আদেশে ১৭ ডিসেম্বরের রদবদলকে রেলের সুনাম ফিরিয়ে আনার কৌশল হিসাবে দেখছে কেউ কেউ।
অন্যদিকে ঊর্ধ্বতন বির্তকিত কয়েকজন কর্মকর্তার একান্ত অনুগতদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের চেষ্টা হিসাবেও অভিযোগ করেছেন অনেকে। অঞ্চলভিত্তিক রেলের ১৩টি বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যেও বদলী আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রজ্ঞাপন সূত্রে জানা গেছে, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার (সিসিএম) এসএম মুরাদ হোসেনকে বাংলাদেশ রেলওয়ে (কর্মচারী) কল্যাণ ট্রাস্ট পূর্বাঞ্চলের (ঢাকা) ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে বদলি করা হয়েছে। পশ্চিমাঞ্চলের সিসিএম এএমএম শাহনেওয়াজ-কে পূর্বাঞ্চলের চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট (সিওপিএস), পূর্বাঞ্চলে সিওপিএস মোহাম্মদ নাজমুল ইসলামকে পূর্বাঞ্চলের সিসিএম হিসেবে বদলি করা হয়েছে। পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় রেল ব্যবস্থাপক (ডিআরএম, চট্টগ্রাম) মো. বোরহান উদ্দিনকে পূর্বাঞ্চলের (ঢাকা) উপ প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী), রেলভবনের পরিচালক (প্রকৌশল) মো. গোলাম মোস্তফাকে পরিচালক (সংগ্রহ, রেলভবন), পশ্চিমাঞ্চলের ডিআরএম (পাকশী) মো. আহসান উল্লাহ ভূইয়াকে পশ্চিমাঞ্চলের সিসিএম, রেলভবনের পরিচালক (সংগ্রহ) মো. মনিরুল ইসলাম ফিরোজী-কে প্রকল্প পরিচালক (বাংলাদেশ রেলওয়ে জয়দেবপুর ঈশ্বরদী ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প) হিসেবে বদলি করা হয়েছে।
অন্যদিকে, রেলভবনের পরিচালক (এসএন্ডপি) আবদুল্লাহ-আল-মাসুদকে উপ-প্রধান পরিকল্পনা (পরিকল্পনা কোষ), পরিচালক (এলএম) তাপস কুমার দাসকে পশ্চিমাঞ্চলের (লালমনিরহাট) ডিআরএম, পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী (অতিরিক্ত সিএমই, সেতু) মনির হোসেন চৌধুরীকে চিফ ট্রেনিং অফিসার/মেকানিক্যাল (আরটিএ, হালিশহর), পশ্চিমাঞ্চলের অতিরিক্ত সিএমই (সেতু) মো. আসাদুল হককে পশ্চিমাঞ্চলের ডিআরএম (পাকশী) হিসেবে বদলি করা হয়েছে। পশ্চিমাঞ্চলের অতিরিক্ত সিএমই সাদেকুর রহমানকে পূর্বাঞ্চলের ডিআরএম (চট্টগ্রাম), পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সেতু) আতাউল হক ভূইয়াকে রেলভবনের পরিচালক (প্রকৌশল), রেলভবনের উপ-প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা (পরিকল্পনা কোষ) মো. রফিকুল ইসলামকে রেলভবনের পরিচালক (এলএম), আরটিএ’র (হালিশহর) সিনিয়র ট্রেনিং অফিসার লিয়াকত শরীফ খানকে পশ্চিমাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সেতু), পশ্চিমাঞ্চলের সেতু প্রকৌশলী আহসান জাবিরকে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত সিএমই, আরটিএ’র চিফ ট্রেনিং অফিসার/মেকানিক্যাল (হালিশহর) মোস্তফা জাকির হাসানকে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত সিএমই, পূর্বাঞ্চলের কর্মব্যবস্থাপক (ডিজেল, ঢাকা) এবিএম কামরুজ্জামানকে রেলভবনের পরিচালক (এসএন্ডপি) হিসাবে বদলী করা হয়েছে। তাছাড়া দীর্ঘ এ বদলী তালিকায় শুধুমাত্র একজনকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে নামেমাত্র।
জানা গেছে, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অপারেটিং বিভাগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদ সিওপিএস ও সিসিএম। পরিবহন ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের দুই প্রধানকে বদলীর মাত্র ছয়মাসের মধ্যেই রদবদল করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে রেলে বড় কয়েকটি দুর্ঘটনার কারণে পরিবহন বিভাগের নিম্নশ্রেণীর কর্মীদের উপর দায় চাপিয়ে একাধিক তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়। এর বিরুদ্ধে পরিবহন বিভাগের চালক, গার্ড-সহ বিভিন্ন গ্রেডের কর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে। যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলেই শুধুমাত্র চালককে দায়ী করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সম্প্রতি চালক-সহ অপারেটিং বিভাগের কর্মীদের বিদেশে প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা করছে রেলওয়ে। রেলপথ মন্ত্রী চালক-সহ অপারেটিং বিভাগের কর্মীদের নিয়ে বৈঠকও করেছেন রেলভবনে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক বড় দুর্ঘটনা, যাত্রী সেবার মান ও আয় কমে যাওয়া-সহ দাফতরিক প্রয়োজনে এই রদবদল হয়েছে। তবে গত দুই যুগের ব্যবধানে বড় এই রদবদলে রেল পরিবহনের নড়বড়ে অবস্থা প্রকাশ পেয়েছে। রেলওয়েতে গুঞ্জন রয়েছে নতুন মন্ত্রী ও মহাপরিচালক আসার পর রেলওয়েতে একাধিক বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া বিপুল বিনিয়োগের পরও রেলের সেবার মান আশানুরূপ বাড়েনি। একের পর এক নতুন ট্রেন সার্ভিস চালুর পরও আয় বৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে রেলে। ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে রেলের আয় হয়েছিল ৯০৪ কোটি টাকা। পরের অর্থ বছরে (২০১৬-১৭ অর্থ বছর) আয়ে বড় ধরণের উলম্ফন হয়। ওই সময়ে রেলের আয় ৪০০ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছিল এক হাজার ৩০৪ কোটি টাকা। এরপর ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে আয় আরও ১৮২ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছিল এক হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। তবে সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে আয় আট কোটি টাকা কমে হয়েছে এক হাজার ৪৮৮ কোটি টাকা। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন খাতে আয় কমে যাওয়ায় সার্বিক আয়ে এর প্রভাব পড়েছে। মূলত কোচ-সহ অবকাঠামো সুবিধা বাড়লেও জনবল ও ইঞ্জিন সংকটে রেলওয়ের সেবার মান আশানুরূপ বাড়ছে না। প্রকল্পের পর প্রকল্প চালু থাকলেও নড়বড়ে রেলপথ, মান্ধাতা আমলের সিগন্যালিং ব্যবস্থা ও অপারেটিং বিভাগে তীব্র লোকবল সংকটের কারণে রেলের রানিং টাইম বেড়ে যাচ্ছে। নিয়মিত দুর্ঘটনাসহ পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে তীব্র শিডিউল বিপর্যয় রেলওয়ের প্রতি মানুষের আস্থা কমিয়ে আনছে দ্রুত।
বিডি প্রতিদিন/এনায়েত করিম