বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্ররাই ছিলেন সামনের কাতারে। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন শুরু করেছিলেন তাঁরা। ’৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি আদায়ে প্রাণ দিয়েছেন ছাত্ররা। বাষট্টির আন্দোলনেও ছাত্রদের ভূমিকা সবচেয়ে এগিয়ে। আর ’৬৯-এর গণ আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক নেতাদের প্রায় সবাই ছিলেন জেলে। ছাত্র-জনতার লড়াকু ভূমিকার কারণেই দেশবাসীর ক্ষোভ গণ অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। স্বৈরাচারী আইউব সরকারের পতন ঘটে। স্বৈরাচারের পতন ঘটালেও সব বিরোধী দলের ওপর অনাস্থা দেখিয়ে ছাত্রনেতারা একটা নতুন রাজনৈতিক মঞ্চ গড়ে তুলতে চাননি। এমনকি স্বৈরাচার এরশাদ পতনের লড়াইয়েও ছাত্রসমাজের বিশাল ভূমিকা থাকার পরেও ছাত্রনেতারা কোনো নতুন রাজনৈতিক দল গড়তে আগ্রহী হননি। অবশ্য ওই দুইবারের জাতীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল পুরোপুরি ভিন্ন ধরনের। আর ছাত্রসংগঠনগুলো ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের একনিষ্ঠ সমর্থক। রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ছাত্রদের আস্থাও সে সময় ছিল অটুট। ছাত্র-জনতার জুলাই গণ অভ্যুত্থানের সময়ে রাজপথেই ৪০ দিনের কম সময়ে প্রায় এক হাজার (এ পর্যন্ত ৮৩৪ জনের তালিকা পাওয়া গেছে) শহীদ; আহত ছাত্র ও অন্য পেশাজীবীর তালিকাভুক্ত সংখ্যা সাড়ে ১২ হাজার। কিন্তু ওই গণহত্যার বিচারকাজের অগ্রগতি হতাশাজনক। এসব বিশ্লেষণ করে শেখ হাসিনার ফ্যাসিজমের তখতে তাউস পতনের সর্বশেষ লড়াইয়ের নেতারা তরুণ সমাজের নিজস্ব রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন এবং সে সাংবিধানিক অধিকার তাঁদের রয়েছে বলে দেশিবিদেশি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত। তাঁরা সারা দেশে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার পর ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের বিশাল এলাকায় জনসমাবেশ করে জাতীয় নাগরিক পার্টির উদ্বোধন ঘটান। আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ প্রধান নেতাদের অনেকেই ভাষণ দেন সেই সমাবেশে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আমন্ত্রিত সীমিত সংখ্যক কেন্দ্রীয় নেতা এবং জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের কিছু কিছু শহীদ পরিবারের সদস্য এবং আহতদের অনেকের উপস্থিতিতে জাতীয় নাগরিক পার্টির শুভ আত্মপ্রকাশ ঘটল। পতিত আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসর কিছু রাজনৈতিক দল ছাড়া সবাই এ নতুন দলটিকে স্বাগত জানিয়েছে। অনেকে বলছেন, শহীদদের পরিবার, আহত ব্যক্তিরা বা তাদের স্বজনদের বেশির ভাগই তরুণদের দ্বারা গঠিত নতুন রাজনৈতিক দলের প্রতি যথেষ্ট আগ্রহী নন। তাঁদের ভয় নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যে বিভক্তি ঘটাতে পারে। তবে বিএনপি শতফুল ফুটতে দেওয়ার মানসিকতায় বিশ্বাসী। এ দলটি ফ্যাসিবাদবিরোধী গণ অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের নিয়েই নির্বাচনের পর সরকার গঠন করতে চায়। বিএনপির পাশাপাশি ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনার আরেকটি দলের আত্মপ্রকাশকে স্বাগত জানাতে তারা মোটেও দেরি করেনি। দেশজুড়ে নিবিড় সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলার আগেই সমাবেশের মাধ্যমে জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশকে বিশাল সাফল্য বলেই মনে করছে বিএনপি। তবে অনেকে বুঝে হোক আর না বুঝেই হোক বিএনপির সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির দূরত্ব সৃষ্টির চেষ্টা করছে। বিএনপি পরিবর্তনের রাজনীতি চায়। দেশে এমন গণতান্ত্রিক বন্দোবস্ত কায়েম করতে চায়, যাতে কোনো দিন ফ্যাসিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। এ জন্য গণতান্ত্রিক শক্তির লৌহ কঠিন ঐক্যও তারা গড়ে তুলতে চায়। এ জন্য কাদাছোড়াছুড়ি নয়, ঐক্যের লক্ষ্যে কথা বলতে হবে নতুন দল এনসিপির নেতৃত্বদানকারী তরুণ-যুবাসংগঠকদের। তারা এ দেশের খেটে খাওয়া কোটি কোটি মানুষের সামনে একটা নতুন রাজনৈতিক দিগন্ত উন্মোচনে সফল হবেন এমন আশা বিএনপিসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী সব দলের।
নতুন দলের অনেক নেতার মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন যে নাহিদ ইসলাম, তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, এ দেশে ‘ভারতপন্থি বা পাকিস্তানপন্থি’ রাজনীতির ঠাঁই হবে না। দেশের মানুষ সোজাসুজি জানতে চায়, নতুন দলের নেতারা এ বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ কিনা। রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান এমনটিই চেয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে গণচীনের সহায়তার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন।
বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী রাজনীতির বিকাশে ভারতপন্থি ও পাকিস্তানপন্থি রাজনীতিকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। গণচীন দেশপ্রেমিক রাজনীতিক জিয়ার ওপরে চীনের নিজস্ব রাজনীতি চাপাতে চায়নি, ওই রাজনীতি চাপানোর কোনো সুযোগই ছিল না। চীনা নেতারা বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী ছিলেন, এখনো তা-ই। রাষ্ট্রনায়ক জিয়া তাঁর প্রতিক্ষণের রাজনীতি দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও প্রকৃত জাতীয়তাবাদী নেতা ছিলেন তিনি এবং সে কারণেই দেশিবিদেশি চক্রান্তকারীরা তাঁকে তাঁর ৪৫ বছর বয়সেই, ১৯৮১ সালেই হত্যা করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারী-হত্যাকারীরা রাজনীতিবিদ জিয়ার আদর্শ উচ্ছেদ করতে পারেনি, পারবে না কোনোদিন। তার বড় প্রমাণ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সীমাহীন নির্যাতন-নিপীড়নের পরও জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক দল বিএনপি সসম্মানে রাজনীতির মাঠে রয়েছে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি জুলাই গণ অভ্যুত্থানের লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টায় জানবাজি সংগ্রাম চালাবে, গণমানুষের সার্বিক মুক্তির পক্ষে, গণতন্ত্র ও সুশাসন কায়েমের উদ্দেশ্যে অসামান্য-আত্মত্যাগের আদর্শ ধারণ করবে তাদের হৃদয়ে-মগজে। দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের মহাসমাবেশের সব বক্তাই সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাঁদের প্রতিশ্রুতিতে আমাদের আস্থা রয়েছে। তবে তাঁদের কেউ কেউ বিএনপির দ্রুত নির্বাচন দাবিকে যেভাবে বাঁকা চোখে দেখছেন, তা দুর্ভাগ্যজনক। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হলে পতিত স্বৈরাচার সুবিধা পাবে, এমনটি ভাবাও হাস্যকর। বিএনপি নির্বাচনমুখী দল। ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াই-সংগ্রামের কারণে এ দলের নেতা-কর্মীরা অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। তাঁরা আগামী নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করতে পারবেন অন্য কোনো দলের সহযোগিতা না পেলেও। জাতীয় নাগরিক পার্টির সাংগঠনিক শক্তির আয়োজন তেমন শক্তিশালী নয় এখন অবধি।
তাদের সামনে প্রধান কাজ জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রকাশ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে তার স্বীকৃতি অর্জন। পাশাপাশি তাদের আসল সংগ্রাম সারা দেশে গণমানুষের মধ্যে সাংগঠনিক ক্ষমতা প্রদর্শন করে গণমানুষের ভোট আদায়ের শক্তিশালী কৌশল প্রদর্শন ও তা বাস্তবায়ন। বিএনপি নয়া দলটিকে স্বাগত জানিয়েছে শুরুতেই। সম্ভাবনা আছে, বিএনপির সঙ্গে নতুন পার্টির নেতাদের নির্বাচনি জোট করার। একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে বিতর্কিত ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলটির সমর্থক নেতা-কর্মী জাতীয় নাগরিক পার্টির মধ্যে আছে বলে মুক্তিযুদ্ধ সপক্ষের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের দৃঢ় বিশ্বাস। তাঁরা এটা প্রকাশ্যেই বলে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু নতুন দলটির নেতারা তা মানতে নারাজ। পুরোনো সেই বিশেষ দলটি এখন বিএনপির সামনে ‘চ্যালেঞ্জ’ হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে তাতে সাফল্যের আশঙ্কা ১০ শতাংশও নেই।
তবে দেশবাসী চায় নাগরিক পার্টি সংবিধান পাল্টানোর অযৌক্তিক বক্তব্য প্রত্যাহার করে সংস্কারের দাবি তুলুক। কারণ পতিত শেখ হাসিনা কোনো সংবিধান অনুসরণ করে চরম নিষ্ঠুরতার রাজনীতি, গণহত্যাযজ্ঞ চালানো, গুম-খুন বা রাজপথে গুলি করে হাজার হাজার মানুষকে পঙ্গু বানানো বা চল্লিশ লাখ কোটি টাকা লুণ্ঠন চালাননি। তিনি সবকিছু করেছেন তার মূর্খামি, (সাইকোপ্যাথ হওয়া) আর ‘কর্তৃত্ববাদী আচরণের পৈতৃক উত্তরাধিকার’ ফলানোর অপচেষ্টায়। তাই ফ্যাসিবাদের অপকর্মের দোহাই দিয়ে সংবিধান পাল্টানোর যৌক্তিকতা নেই। সংস্কার করাটাই দেশবাসী সমর্থন করবেন। আর নাগরিক পার্টির নেতারা মুক্তিযুদ্ধ এবং জাতীয় নেতাদের অবজ্ঞা করার মতো আত্মঘাতী বোকামি যেন না করেন। তাদের কাছে মানুষ সুস্থ রাজনীতি আশা করে।
লেখক : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক