ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী (১৯৪১-২০২৩) চিকিৎসক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সমাজসেবক, মানবাধিকারকর্মী, দুস্থ-অসহায় মানুষের বন্ধু, জাতীয় ঔষধনীতির প্রণেতা, গণবিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, ‘গণমানুষের ডাক্তার’ হিসেবে খ্যাত। জাফরুল্লাহ চৌধুরী- কর্মপ্রাণ, চিরতরুণ, মানবপ্রেমী, দেশপ্রেমে উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের নাম। জাফরুল্লাহ চৌধুরী ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজানের কয়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হুমায়ুন মোর্শেদ চৌধুরী এবং মাতা হাসিনা বেগম চৌধুরী। পিতা ছিলেন পুলিশ অফিসার আর মাতা গৃহিণী। ১০ ভাইবোনের মধ্যে জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন সবার বড়। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেন ছিলেন তাঁর বাবার শিক্ষক। আর সে জন্যই তাঁর রক্তেই মিশে আছে বিপ্লবী চেতনা ও গণমানুষের মুক্তির অনির্বাণ আগুন। বেহুলা বাংলায় তিনি ছিলেন এক অবিনাশী ফিনিক্স পাখি।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী পুরান ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউশন থেকে মেট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৬৬ সালে তিনি এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর এফআরসিএস পড়ার জন্য তিনি লন্ডনে যান। চতুর্থ বর্ষে পড়াশোনা শেষে যখন চূড়ান্ত পরীক্ষায় অবতীর্ণ হবেন, ঠিক তখন পাকিস্তানি সেনাদের নিরস্ত্র বাঙালির ওপর গণহত্যা পরিচালনা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনা। পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার পরিবর্তে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সংকল্প গ্রহণ করেন। এরই সঙ্গে তাঁর উচ্চশিক্ষা গ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়।
কলেজজীবন থেকে জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন। লন্ডনে থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় গঠিত মুজিবনগর সরকারের জন্য তহবিল সংগ্রহ এবং মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাদানে গঠিত বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির ব্যানারে লন্ডনের জনগণ ও ব্রিটিশ আইন প্রণেতাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন-সহানুভূতি লাভে তিনি স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন নামে বাঙালি চিকিৎসকদের নিয়ে সেখানে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন এর সাধারণ সম্পাদক। প্রথম দিকে কলকাতা ও ভারতের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় নেওয়া বাঙালি শরণার্থীদের জন্য ওষুধসামগ্রী সংগ্রহ ও প্রেরণ ছিল এর প্রধান কাজ। পাকিস্তানের প্রতি অনুগত্য প্রত্যাখ্যানস্বরূপ লন্ডনের সড়কে বাঙালির এক র্যালিতে অংশগ্রহণ অবস্থায় প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পাসপোর্ট ছিঁড়ে তিনি টুকরো টুকরো করে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন।
একপর্যায়ে তিনি বাংলায় ফিরে এসে প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে মনস্থির করেন। অবশেষে ডা. এম এ মবিনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় এসে পৌঁছাতে সক্ষম হন। এদিকে ত্রিপুরার মেলাগরে ছিল মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের হেড কোয়ার্টার্স। যুদ্ধাহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও সেবাদানের লক্ষ্যে খালেদ মোশাররফের উদ্যোগে সেখানে বাঁশ ও খড় দিয়ে নির্মাণ করা হয় বাংলাদেশের ফিল্ড হাসপাতাল। লন্ডন থেকে ওষুধ ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি নিয়ে এসে জাফরুল্লাহ ও মবিন এ হাসপাতালে যোগ দেন। আরও কয়েকজন ডাক্তার, কিছুসংখ্যক নার্সসহ মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় তাঁরা সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যান। মাত্র তিন সপ্তাহ ট্রেনিং দিয়ে শতাধিক নারীকে নার্স হিসেবে গড়ে তোলেন তিনি। এ যেন আলাদিনের চেরাগ। স্বাস্থ্যসেবার একাডেমিক ডিসকাসে যুক্ত হলো নতুন জ্ঞানের, নতুন চিন্তার।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর অসহায় গণমানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের মহান ব্রত নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকার অদূরে সাভারে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রতিষ্ঠা করেন এক ব্যতিক্রমধর্মী হাসপাতাল। নাম ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি একই ধরনের প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। এর মধ্যে কিডনি রোগীদের স্বল্পমূল্যে ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থাকল্পে ঢাকার নগর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র তাঁরই উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ১০০ শয্যাবিশিষ্ট একটি সেন্টার বা ইউনিট।
ডা. জাফরুল্লাহ কিডনি জটিলতাসহ নানা রোগে ভুগছিলেন। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁর স্বাস্থ্য আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। ২০২৩ সালের ১১ এপ্রিল তাঁরই প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নগর হাসপাতালে ৮১ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ক্যাম্পাসে তাঁর মৃতদেহ সমাহিত করা হয়। তিনি স্ত্রী শিরিন হক, এক কন্যা ও পুত্র সন্তান রেখে যান। তাঁর মৃত্যুর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কেবল দেহের চিকিৎসক নয়, তিনি সমাজেরও চিকিৎসক ছিলেন।’ এই একটি চরণই তাঁর মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট। মহান এই কৃতী বাঙালির তৃতীয় প্রয়াণ দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা। বিনাশী জীবনে তিনি অবিনাশী প্রাণ।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক