প্রখ্যাত অভিনেতা প্রবীর মিত্রের অভিনয়ের বয়স এখন চার দশকেরও বেশি। তবে এখন তেমন ভালো নেই তিনি। আগের মতো কাজের ডাক পান না। ব্যস্ততা কম বলে শরীরও তেমন একটা ভালো থাকে না। তার কথায় সুখে-দুঃখে কোনোভাবে সময় কেটে যাচ্ছে। অভিনয় নিয়ে আগের মতো ব্যস্ততা নেই কেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি দুঃখ করে বলেন, এখন সব জায়গায় গ্রুপিং। গ্রুপের লোকজন পরিচালকের আশপাশে থাকে। তাকে তোয়াজ করে চলে, কাজ পায়। কাজের জন্য হাত পাতে। আমি কিন্তু এসবের মধ্যে নেই। আমি একজন জাত অভিনেতা। আমার দক্ষতাতেই কাজ পেতে চাই। অন্য কোনোভাবে নয়।
চলচ্চিত্রে অভিনয়ের নেশায় চাকরি বা ব্যবসা কিংবা অন্য কিছু করা হয়নি আমার। অভিনয় অস্থিমজ্জা আর রক্তে মিশে আছে। এখনো অভিনয়ের নেশায় চিত্রজগতে ছুটে যাই। যতক্ষণ দেহে প্রাণ থাকবে ততক্ষণ অভিনয় করে যাব। কারণ একজন শিল্পীর প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে মানুষকে বিনোদন দেওয়া, মানুষের মনকে আনন্দে ভরিয়ে তোলা। শিল্পী হিসেবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাই করব। বর্তমানে অল্প কয়েকটি চলচ্চিত্রে কাজ করছি। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মনতাজুর রহমান আকবরের 'আগে যদি জানতাম তুই পর হবিরে', মোহাম্মদ হোসেনের একটি এবং নজরুল ইসলামের 'রানা প্লাজা'।
সিনিয়র শিল্পীদের আগের মতো কদর নেই বলেও জানান এই গুণী শিল্পী। তার কথায় বিষয়টি নিয়ে আক্ষেপ হয়। কারণ বয়স হয়ে গেলে সবাই কেমন যেন এড়িয়ে চলতে চায়। আনোয়ার হোসেনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। এটি সত্যিই দুঃখজনক। আসলে এখন নতুন যারা নির্মাণে আসছে তারা মনে হয় সিনিয়রদের নিয়ে কাজ করতে ভয় পায়। যদি তাদের ভুলত্রুটি নিয়ে কথা বলি। এ জন্যই হয়তো আমাদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে চায় তারা।
বর্তমানে চলচ্চিত্রের অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, ভালোই তো। প্রচুর ছবি নির্মাণ হচ্ছে। তবে প্রকৃত নির্মাতার সংখ্যা কম। নতুনরা যথার্থ চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারছে না। ডিজিটালের নামে টেলিফিল্ম নির্মাণ করতে গিয়ে শুরুতেই দর্শক গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে। চলচ্চিত্রের ব্যবসার বিষয়েও তারা অজ্ঞ। এফডিসিতে তেমন একটা যাওয়া হয় না বলেও জানান তিনি। দুঃখ করে তিনি বলেন, এফডিসি এখন ভুতুড়ে বাড়ি। ওখানে চলচ্চিত্রের কোনো কাজ হয় না। তার কথায়-চলচ্চিত্র নির্মাণই কমে গেছে, কাজ হবে কোথা থেকে। সেখানে এখন আর শিল্পী বা নির্মাতারা তেমন যায় না। চলচ্চিত্রের চেয়ে টিভি অনুষ্ঠানের কাজ বেশি হয় সেখানে। আর দারোয়ানরা টাকা নিয়ে রাস্তার লোকজনকে ভেতরে ঢুকায়। বলতে গেলে এফডিসিতে এখন আর কাজ ছাড়া যাওয়ার পরিবেশ নেই। অথচ একসময় চলচ্চিত্রের মানুষের মিলনমেলা ছিল এই এফডিসি। বিষয়টি এই অভিনেতাকে ভীষণ পীড়া দেয়। তার কথায়, 'এফডিসি আমার কাছে তীর্থস্থানতুল্য। এখান থেকেই রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়েছে, পরিচিতি পেয়েছি। বলা যায় এফডিসিই আমার জন্মস্থান। অথচ নিজের জন্মস্থান এবং তীর্থভূমিতেই যেতে পারি না। এর চেয়ে বড় দুঃখের ব্যাপার আর কী হতে পারে?' এখন সময় কাটে কীভাবে? এ প্রশ্নে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, চেষ্টা করি সবার সঙ্গে মিলেমিশে থেকে জীবনের বাকি দিনগুলো কাটাতে। তাই সবার খোঁজখবর নেই। সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। সুযোগ এবং সময় হলেই কাকরাইলে ফিল্মপাড়ায় যাই। চলচ্চিত্রের লোকজনের সঙ্গে গল্প করে সময় কাটাই। এখন যারা অভিনয়ে আসছে তারা সহজেই হারিয়ে যাচ্ছে কেন? এ প্রসঙ্গে তার কথা হলো- 'আমরা তো একদিনে শিল্পী হইনি, প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে। রেডিও, টিভি, মঞ্চসহ সবক্ষেত্রে বিচরণ করে অভিনয় শিখে তবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছি। কিন্তু এখন যারা আসছে তারা তো পরিশ্রম ছাড়াই রাতারাতি স্টার হতে চায়। এটি তো সম্ভব নয়। তাই তারা এসেই ঝরে পড়ছে। পরিচালনায় আসতে চান না তিনি, কারণ তার কাছে পরিচালনা অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ। তাই পরিচালনাকে ভয় পান। অভিনেতা পরিচয়েই থাকতে চান তিনি। অভিনয়জীবনে প্রাপ্তি নিয়ে কোনো আফসোস নেই বলে জানান রঙিন সিরাজউদ্দৌলা খ্যাত এই অভিনেতা। তিনি বলেন, অভিনয় করে দর্শকের ভালোবাসা পেয়েছি। হয়তো গাড়ি-বাড়ি করতে পারিনি। তবে সৎ ও সুন্দর উপায়ে জীবনযাপন করছি। কাউকে তোষামোদ করে চলতে হয়নি, এটা আমার কাছে বিশাল পাওয়া। তাই আফসোস নেই। ভালো থাকতে এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অভিনয় করে যেতে চাই।