ধীরগতিতে এগুচ্ছে এফডিসির আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ। গত বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সিকিভাগ কাজও এখনো শেষ হয়নি। ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত সময় বৃদ্ধির আবেদন জানিয়েছে এফডিসি কর্তৃপক্ষ। তবে আশার কথা হলো, ইতিমধ্যে আংশিকভাবে ডিজিটাল ক্যামেরা এসেছে, ডিজিটাল ডাবিং ও ডিজিটাল এডিটিংও আংশিক চালু হয়েছে। কয়েকজন সাবেক এমডি বলছেন, অদূরদর্শিতা ও দুর্নীতির কারণেই দৈন্যদশা কাটছে না এফডিসির।
এফডিসির বয়স এখন প্রায় ৫৭ বছর। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বদল হয়েছে ৩৩ বার। কিন্তু সংস্থাটির ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। কাটেনি দৈন্যদশা। ফ্লোর, মেকআপ রুম, কালার ল্যাব, প্রশাসনিক ভবনসহ পুরো সংস্থাটিই এখন শ্রীহীন ও সংস্কারবিহীন অবস্থায় পড়ে আছে।
২০১১ সালের ১৮ অক্টোবর একনেকের বৈঠকে 'এফডিসির আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প' বিলটি পাস হয়। ৫৯ কোটি ১৮ লাখ টাকার এই প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় তিন বছর। সেই হিসাবে ২০১৪ সালের ৩০ জুন প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু জ্ঞান গরিমাহীন অযোগ্য ও দুর্নীতিবাজ কিছু এমডির কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয় বলে চলচ্চিত্রকারদের অভিযোগ। গত বছরের এপ্রিলে এফডিসিতে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব হারুন-অর-রশিদ। তার যোগদানের পর প্রথমে তিনটি ডিজিটাল ক্যামেরা আনা হয়। এর আগে অবশ্য ডাবিং থিয়েটারকে আংশিক ডিজিটাল করা হয়। আর গত সপ্তাহে দুটি ডিজিটাল এডিটিং মেশিন আনা হয়েছে।
ভারপ্রাপ্ত এমডি হারুন-অর-রশিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, "আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছি এফডিসিকে আধুনিক রূপ দিতে। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনটি ক্যামেরা ও সম্প্রতি দুটি ডিজিটাল এডিটিং মেশিন আনিয়েছি। শিগগিরই আরও ছয়টি ক্যামেরা, পাঁচটি এডিটিং প্যানেল, কালার কারেকশন ও ডিজাইন মেশিন আসছে। এগুলো এসে গেলে পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ শুরু করা যাবে। আগামী মাসের মধ্যেই এই কাজ সম্পন্ন হবে। আশা করছি, জুনের মধ্যে টেকনিক্যাল সেক্টরের কাজ শেষ হবে। অন্য সংস্কার কাজ আগামী বছরের জুনের মধ্যে সম্পন্ন করা যাবে। দুটি ফ্লোর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করা হবে। ফ্লোর, মেকআপ রুম থেকে শুরু করে সব কিছুই আধুনিক করে গড়ে তোলা হবে। ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত সময় বৃদ্ধির জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছি। দায়িত্ব গ্রহণ করে এফডিসিকে আবর্জনামুক্ত করতে পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করেছি। এফডিসিকে উন্নত সেবাদানের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। চলচ্চিত্রকারদের ওয়ানস্টপ সেবা দিতে শক্তিশালী টিম গঠন করব। এ জন্য চলচ্চিত্রকারদের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।"
এদিকে, ২০০৪ সালে ডিজিটাল কমপ্লেঙ্ স্থাপনের জন্য সরকার ২১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। কিন্তু সেই অর্থ লুটপাটের কারণে ডিজিটাল কমপ্লেক্সটি আলোর মুখ দেখেনি। একটি মাত্র সাব টাইটেল মেশিন অকেজো। ছয় বছর আগে কোটি টাকা ব্যয়ে ডিটিএস মেশিন কেনা হলেও ত্রুটিপূর্ণ থাকায় তা সচল হয়নি। একই সময় কেনা ডিজিটাল এডিটিং মেশিনগুলোও অচল। কালার ল্যাবের মেশিনগুলো পুরনো হওয়ায় প্রায় সময় বিকল হয়ে যায়। যন্ত্রাংশ স্থানীয় বাজারে না থাকায় টেন্ডার আহ্বান করে বিদেশ থেকে আমদানি করতে গিয়ে অতিরিক্ত সময় লাগে। এফডিসির স্টোর ব্যবহার অনুপযোগী হওয়ায় সেখানে নষ্ট হয়ে গেছে কালজয়ী চলচ্চিত্রের সব নেগেটিভ ও প্রিন্ট। ঝরনা স্পটের ঝরনা অকেজো। সুইমিংপুল ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি। এফডিসির আঙিনাজুড়ে শুধুই আবর্জনার স্তূপ। যত্রতত্র পোস্টার লাগানো এবং চুনকাম না করায় শ্রীহীন অবস্থায় রয়েছে সংস্থার ভবন ও বাউন্ডারি দেয়ালগুলো। নয়টির মধ্যে চালু সাতটি শুটিং ফ্লোরের অবস্থাও জরাজীর্ণ। প্রায় সময় ফ্লোরের ফলস সিলিং ও পলস্তারা খসে পড়ে আহত হন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা। মেকআপ রুমগুলোও অপরিচ্ছন্ন এবং সংলগ্ন টয়লেটগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করায় দুর্গন্ধে শিল্পীদের এখানে বসতে কষ্ট হয়। ৫৭ বছর বয়সী এ সংস্থার ভবনগুলো পুরনো হওয়ায় এগুলো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এফডিসির প্রবেশদ্বারেই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাস্কর্য। চরম অবহেলায় নোংরা-আবর্জনার মধ্যে পড়ে আছে এটি। জহির রায়হান কালার ল্যাবের দেয়াল ও ছাদের পলস্তারা খসে পড়ছে কেমিক্যালের বিরূপ প্রভাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন চলচ্চিত্রকার বলেন, অত্যাবশ্যকীয় লোকের পরিবর্তে বহিরাগতদের দখলে রয়েছে এফডিসি। সংস্থার প্রবেশদ্বারেই পুলিশ চৌকি এবং প্রায় ৩০ জন প্রহরী। পাস নিয়ে প্রবেশের বাধ্যবাধকতা থাকলেও এখন তার বালাই নেই। মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে মানুষ এবং গাড়ি চেকের ব্যবস্থাও নেই। ইচ্ছা করলেই বাইরের লোকজন সহজেই এখানে প্রবেশ করতে পারে।
চলচ্চিত্রকারদের কথায়, প্রশাসনের নামে চলে দলবাজি আর গ্রুপিং। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড স্থবির। কেপিআইভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও এফডিসির উন্নয়ন নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে সংস্থাটি।