ভারতীয় ছবি ঠেকাও, না হলে আমাদের সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে যাবে বলে চেঁচিয়ে গলা ফাটাচ্ছি, কিন্তু আমরাই অহরহ ভারতীয় ছবির নকল করছি। মাঝেমধ্যে নকলের বিষয়টি এতটাই প্রকাশ্য হয় যে, তা দিন-দুপুরে ডাকাতি মনে হয়। আর এভাবেই চলছে ঢাকার বাণিজ্যিক ছবির নির্মাণ। এতে দর্শকের মনে ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, ঢালিউডের ছবি মানেই ভারতীয় ছবির নকল। এক-দেড় দশক আগে হিন্দি ছবি থেকে টুকলিফাই করা হতো। এখন তামিল, তেলেগু, মারাঠি, কোরিয়ানসহ বিভিন্ন ছবি থেকে ছবি নকল করা হচ্ছে। তামিল, তেলেগু, মারাঠি ছবি নকল করতে গিয়ে আশ্রয় নিতে হচ্ছে সুইপার কলোনির। হিন্দি ভাষা অনেকটা আয়ত্তে থাকলেও এই তিন ভাষার অনুবাদ এখনো সহজসাধ্য নয়। অনুবাদের জন্য নির্মাতারা মাদ্রাজি সুইপারদের দ্বারস্থ হচ্ছেন।
চলচ্চিত্রবোদ্ধারা বলছেন, অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে বছরের প্রায় ৯০ ভাগ ছবি নকলের অভিযোগে অভিযুক্ত। উদাহরণ হিসেবে গত বছরের তিনটি ছবির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। ছবি তিনটি রীতিমতো পোস্টার কপি করে হৈচৈ ফেলে দেয়। এগুলো হলো- 'ডেয়ারিং লাভার', 'রাজত্ব' ও 'অল্প অল্প প্রেমের গল্প'। প্রথম ছবিটি ২০০৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তামিল 'থিরভিলাইয়াডাল আরামবাম' ও কলকাতার 'ইডিয়ট' ছবির নকল। এর পোস্টার বলিউডের 'তিসমার খান' ছবির পোস্টারের হুবহু। 'রাজত্ব' ছবিটি হিন্দি 'ওয়ানটেড' ছবির আংশিক নকল। এর পোস্টার নকল করা হয়েছে হিন্দি 'আর রাজকুমার' ছবির পোস্টার থেকে এবং 'অল্প অল্প প্রেমের গল্প' ছবির পোস্টার নকল করা হয়েছে হলিউডের 'দ্য আগলি ট্রুথ' ছবির পোস্টার থেকে। প্রায় সব ছবির পোস্টারই কোনো কোনো বিদেশি ছবির নকল। আসলে এটাকে নকলও বলা যায় না, বিদেশি ছবির পোস্টারে নিজেদের শিল্পীদের গলা-মুখ জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা নকলের চেয়েও বড় অপরাধ।
শুধু কাহিনী নয়, গানের ক্ষেত্রেও নকলের অভিযোগ প্রচুর। 'ভালোবাসা আজকাল' ছবির গানের সুর চুরি করা হয়েছে হিন্দি 'আশিকি-টু' ছবি থেকে।
গত দুই বছরের কয়েকটি নকল ছবির তালিকা থেকে বোঝা যাবে নকলের দৌরাত্দ্যে ঢালিউডের ভয়াবহ অবস্থার কথা। পোড়ামন, প্রেম প্রেম পাগলামী, ফাঁদ নিয়ে নকলের অভিযোগ রয়েছে। ভালোবাসা এক্সপ্রেস ছবিটি নকল করা হয়েছে ২০১২ সালের তেলেগু ছবি 'রেড দ্য কালার অব লাভ' থেকে। এ ছবিটি হিন্দিতে 'ডেঞ্জারাস খিলাড়ি', মালায়াম 'গাজাপাক্কিরি' ও তামিল ভাষায় 'সাহাসাস' নামে আগেই নির্মাণ হয়েছে। গত বছরের 'হিটম্যান' ছবিটি তামিল 'ভিট্টাই' ছবির নকলের দায়ে সেন্সর বোর্ড প্রথমে আটকে দিলেও পরে আপিল করে ছাড়পত্র পায়। 'আই ডোন্ট কেয়ার' নকল করা হয়েছে তামিল ছবি 'রিবেল' থেকে। 'ফুল অ্যান্ড ফাইনাল' ছবির স্টোরি লাইন কপি করা হয়েছে কোরিয়ান ছবি 'ডেইজি' থেকে। 'আমি শুধু চেয়েছি তোমায়' গত বছরের সবচেয়ে বড় ব্যবসা সফল ছবি। এটি নকল করা হয়েছে তামিল ছবি 'আরিয়ান' থেকে। 'জান কোরবান' নকল করা হয়েছে কলকাতার 'আই লাভ ইউ' থেকে, 'অন্যমানুষ' কলকাতার 'অমানুষ' ছবি থেকে।
চলচ্চিত্রবোদ্ধারা বলছেন, মূলত সত্তরের দশক থেকেই ঢাকার ছবি নকল হতে শুরু করে। তখনকার আর এখনকার নকলের মধ্যে পার্থক্য হলো- তখন নির্মাতারা নকলেও মেধার পরিচয় দিত। মানে 'চুরিতেও বুদ্ধি লাগে' এই পরিচয় অক্ষুণ্ন রাখত। নিজের মতো করে অন্য ছবির গল্প সাজিয়ে বানাত। তা ছাড়া ছবি বা গানের ক্ষেত্রে ছবির টাইটেলেই 'একটি বিদেশি ছবির ছায়া অবলম্বনে' কথাটি লিখে দিত। এখন মেধাশূন্য নির্মাতা হওয়ার কারণে এসবের বালাই নেই।
সত্তরের দশক থেকেই দেশে নকল ছবির নির্মাণ শুরু হয়। কিন্তু সংখ্যায় ছিল কম। এরপর নব্বই দশক থেকে মূলত নকলের রমরমা বাণিজ্য শুরু হয়। সত্তর-আশি-নব্বই দশকে নকল হলেও নির্মাতাদের চোখে লজ্জা নামক পর্দা ছিল। এখন কোনো পর্দা নেই কারও চোখে। নির্দ্বিধায় বুক ফুলিয়ে নকল করে যাচ্ছেন তারা। আবার উঁচু গলায় তা বলেও বেড়াচ্ছেন। বর্তমানে নকল হচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রে। গল্প, শট টু শট, কস্টিউম থেকে শুরু করে পোস্টার- সবই। চলচ্চিত্রকাররা বলছেন, বর্তমানে যে হারে হিন্দি বা বিদেশি ছবির নকল চলছে তাতে অনেক আগেই সিনেমা হল দর্শকশূন্য হয়েছে এবং সিংহভাগ সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই এ দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।
প্রখ্যাত অভিনেতা ফারুক বলেন, 'যাদের মেধা নেই, তারাই এমন গর্হিত কাজ করে। কতিপয় অসাধু লোক পরিশ্রম না করে রাতারাতি অর্থবিত্তের মালিক হতে চায়। এরা নকলের আশ্রয় নিয়ে আমাদের চলচ্চিত্রের বারোটা বাজাচ্ছে। আমি বলি আপনারা কী দেশটাকে মগের মুল্লুক পেয়েছেন? আসলে এ অবস্থার জন্য সেন্সর বোর্ড দায়ী। নকল চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারলে সেন্সর বোর্ডের প্রয়োজন কী!'
বর্তমানে মাত্র ১০ ভাগ ছবি মৌলিক হচ্ছে। কিন্তু এ ১০ ভাগ মৌলিক ছবির নির্মাতাদের ছবি মুক্তির সময় দেখা যায় উল্টো চিত্র। ৯০ ভাগ নকল ছবির নির্মাতারা উঠে-পড়ে নামেন এই মৌলিক ছবিগুলোকে জোর করে টেলিফিল্ম বা নাটকের তকমা লাগানোর জন্য। শুধু তাই নয়, ছবিগুলোকে ফ্লপ করানোর চেষ্টাও চালান। তাই সচেতন চলচ্চিত্রকর্মীরা মনে করেন, নিজের অপরাধ বাণিজ্য [নকল ছবি] চালিয়ে যেতেই তারা মৌলিক ছবির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেকে এটাও মনে করেন, ভারতীয় ছবির বিরুদ্ধে আন্দোলনও একই কারণে। দেশের মৌলিক ছবি এবং ভারতীয় ছবি নিয়মিত দেশের প্রেক্ষাগৃহে চললে নকল ছবি নিয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়বেন তারা।
দেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে এগিয়ে নিতে সচেতন দর্শক এবং চলচ্চিত্রকর্মীরা দ্রুত নকলমুক্ত চলচ্চিত্র নির্মাণের জোর দাবি জানিয়েছেন। আর এ জন্য সেন্সর বোর্ডকে যথাযথ দায়িত্ব পালনের আহ্বান তাদের।