১২ রবিউল আউয়াল পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের এই দিনে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক ও আল্লাহর প্রিয় রাসূল হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) এই পৃথিবীতে আগমন করেন। ৬৩ বছরের ব্যবধানে একই দিনে অর্থাৎ ১২ রবিউল আউয়াল দুজাহানের নবী ও আল্লাহর প্রিয় হাবিব ওফাত লাভ করেন। মুসলিম জাহানের ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে এই দিনটি একটি পবিত্রতম দিন। গোটা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশও যথাযথ মর্যদা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে দিনটি উদযাপন করবে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশে আজ সরকারি ছুটি। ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে আজ সকালে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে জশনে জলুস ও ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর র্যালি বের করা হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠন আলোচনা সভা, দোয়ার মাহফিল, ওয়াজ মাহফিল, কোরানখানি, ফাতেহা খানি, মিলাদ-মাহফিলের আয়োজন করেছে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা কোরআন তেলাওয়াত, হাদিস শরিফ পাঠ, নফল নামাজ, ইবাদত বন্দেগি ও কবর জেয়ারত করে দিনটি উদযাপন করবেন। ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া পৃথক বাণীতে বলেন, হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শিক্ষা সমগ্র মানবজাতির জন্য অনুস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেন, মহান আল্লাহ সমগ্র বিশ্বজগতের রহমত হিসেবে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে এ জগতে প্রেরণ করেন। সর্বশেষ মহাগ্রন্থ পবিত্র কোরআন তাঁর নিকট অবতীর্ণ করে জগতে তাওহীদ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব অর্পণ করেন। প্রধানমন্ত্রী বাণীতে বলেন, বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুপম শিক্ষার অনুসরণের মাধ্যমেই বিশ্বের শান্তি ও কল্যাণ নিশ্চিত হতে পারে। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পৃথিবীতে আগমনের ফলে দুনিয়ার মানুষ এক আল্লাহর দাসত্ব করার সৌভাগ্য লাভ করেছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রিয় নবীর মাধ্যমে দুনিয়ার মানুষের সামনে ইসলাম ধর্মের অনুপম আদর্শ পেশ করেন। ইসলাম পৃথিবীতে ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর করে সমাজে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠা, ব্যক্তিজীবনে ইনসাফ ও আদল প্রতিষ্ঠা, ভূমি ও সম্পদে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার শিক্ষা দেয়। ইসলাম দুনিয়া ও আখিরাতে এক আল্লাহর আনুগত্য প্রতিষ্ঠার ধর্ম। ইসলামের মূলগ্রন্থ পবিত্র কোরআন আল্লাহর বাণী হিসেবে প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে নাজিল হয়েছে। নবী (সা.) তার জীবনাচরণের মাধ্যমে মানুষকে হিংসা-বিদ্বেষ, অন্যায়, অসৎ ও কুফরির পথ ছেড়ে কোরআনের নির্দেশিত পথে চলার শিক্ষা দিয়েছেন। নবীজীর এসব শিক্ষা পবিত্র হাদিস গ্রন্থ হিসেবে সাহাবায়ে কেরামরা (রা.) সংকলিত করে রেখেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম মানব হিসেবে স্বীকৃত, মানবতার মুক্তিদূত মুহাম্মদ (সা.) আরবের বিখ্যাত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের ছয় মাস পূর্বে তাঁর পিতা আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। আর মাত্র ছয় বছর বয়সে নবীজী হারান তাঁর স্নেহময়ী মা আমিনাকেও। চাচা আবু তালিবের কাছে পিতৃস্নেহে লালিত-পালিত হন তিনি। যুবক বয়সে নবীজীর সততায় মুগ্ধ হয়ে আরবের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হজরত খাদিজা (রা.) তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে চাচার সম্মতিতে তিনি রাজি হন। বিয়ের পর আল্লাহর নবী হেরা গুহায় মোরাকাবা বা ধ্যান শুরু করেন। ৪০ বছর বয়সে আল্লাহপাক সন্তুষ্ট হয়ে প্রিয় নবী মুহাম্মদ মুস্তফা আহমদ মুজতাবা (সা.)-কে নবুয়্যাত দান করেন এবং দুনিয়ার মানুষের কাছে আল্লাহর একাত্দবাদ ও ইসলাম প্রচার করতে আদেশ দেন। হজরত খাদিজা (রা.) প্রথম ইসলাম কবুল করেন। ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে আল্লাহর রাসূল (সা.) তীব্র প্রতিরোধ ও প্রচণ্ড নির্যাতনের শিকার হন। কাফেররা নবী করিম (সা.)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র করলে আল্লাহ নির্দেশে তিনি মক্কা নগর থেকে মদিনায় হিজরত করেন। সেখানে আল্লাহর নবী (সা.) ইহুদি সম্প্রদায়সহ বিভিন্ন ধর্মীয় গোত্রের সঙ্গে শান্তি ও নিরাপদে বসবাসের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ইতিহাসে এটি ঐতিহাসিক মদিনা সনদ হিসেবে স্বীকৃত। এটিই বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধান। এরপর ৬ষ্ঠ হিজরিতে সাহাবিদের নিয়ে প্রথম আনুষ্ঠানিক হজ করতে এলে কাফেররা বাধা দেয়। এ সময় স্বাক্ষরিত হয় মক্কাবাসীর সঙ্গে আল্লাহর নবীর (সা.) ঐতিহাসিক হুদাইবিয়ার সন্ধি চুক্তি। মদিনায় ফিরে গিয়ে তিনি পুনরায় ইসলামের দাওয়াত দেওয়া শুরু করেন। এ সময় রোম সম্রাট, পারস্য সম্রাট, মিসরের শাসনকর্তাসহ বিভিন্ন রাজা-বাদশাহর কাছে বিশ্বনবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দূত ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিতে থাকেন। এদিকে একের পর এক হামলা মোকাবিলায় নবীজীকে হিজরি ২য় সনে বদর, হিজরি ৩য় সনে ওহুদ সহ ২৭টি প্রতিরোধ যুদ্ধে সরাসরি নেতৃত্ব দিতে হয়। ৭ম হিজরিতে ইহুদিরা মদিনা সনদ অমান্য করলে সন্ধি ভঙ্গের জন্য আল্লাহ রাসূল (সা.) তাদেরকে মদিনা থেকে বিতাড়িত করেন। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে তথা ৮ম হিজরিতে মক্কার কুরাইশরা হুদাইবিয়ার সন্ধি ভঙ্গ করলে নবী করিম (সা.) পবিত্র রমজান মাসের ১০ তারিখে ১০ হাজার সাহাবা নিয়ে মক্কাভিমুখে রওনা হন। মক্কায় পৌঁছে দয়াল নবী ঘোষণা করেন, যারা নিজ ঘরে ও কাবা ঘরে আশ্রয় নেবে তারা সাধারণ ক্ষমা পাবে। এরপর প্রায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই আল্লাহর নবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কা নগরে প্রবেশ করেন। ইতিহাসে একে মক্কা বিজয় হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। মক্কা বিজয়ের পর কারও ওপর কোনো প্রতিশোধ গ্রহণ করা হয়নি। আল্লাহর নবী (সা.) কাবা শরিফের ভিতরে রাখা ৩৬০টি মূর্তি ভেঙে ফেলেন। এ সময় তিনি বেলাল (রা.)-কে কাবা শরিফের চূড়ায় উঠে আজান বা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণার নির্দেশ দেন। ১০ম হিজরিতে বিশ্বনবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) জীবনের শেষতম পবিত্র হজ পালন করেন। এই বিদায় হজের সময় আল্লাহপাক ওহি নাজিল করে ইসলামকে পরিপূর্ণ ধর্ম এবং তাঁর মনোনীত জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ঘোষণা করেন। বিদায় হজের খুৎবায় মানবতার মুক্তিদূত রাসূলুল্লাহ (সা.) মানবজাতির জন্য শান্তি, কল্যাণ ও নিরাপত্তার দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। এরপর মদিনা শরিফ ফিরে গিয়ে তিনি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। ১১ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার রাহমাতুলি্লল আলামিন বা বিশ্বজগৎসমূহের রহমতের দূত প্রিয় নবী (সা.) ওফাত লাভ করেন। জশনে জুলুস : ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশন সকাল ১০টায় শিশু সমাবেশ ও র্যালি অনুষ্ঠিত হবে। নবনিযুক্ত ধর্ম মন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান র্যালিতে নেতৃত্ব দেবেন। আনঞ্জুমানে রহমানিয়া মইনীয়া মাইজভাণ্ডারীয়া সকাল ৮টায় রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জমায়েত হবে। এরপর আলহাজ শাহছুফী মাওলানা সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ আলহাসানী ওয়াল হোসাইনী আল মাইজভাণ্ডারীর নেতৃত্বে সকাল সাড়ে ১০টায় জশনে জুলুস বের হবে। আশেকানে মাইজভাণ্ডারী অ্যাসোসিয়েশন জশনে জুলুস বা ধর্মীয় আনন্দ মিছিলের আয়োজন করেছে। রাজধানীর শাজাহানপুর রেলওয়ে ময়দান থেকে দুপুর সাড়ে ১১টায় আলহাজ মাওলানা সৈয়দ মুজিবল বশর আলহাছানী আল মাইজভাণ্ডারী নেতৃত্বে এ জুলুস শুরু হবে। এর আগে সকাল ৯টায় এখানে আলোচনাসভা হবে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে জশনে জুলুস করবে। আলোচনা সভা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন পক্ষকালব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। এর মধ্যে আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচি রয়েছে। জাতীয় প্রেস ক্লাব : বাদ আসর নিজস্ব মিলনায়তনে আলোচানা সভা ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছে। আশেকে রাসূল (সা.) সম্মেলন : সকাল থেকে বাদ জহুর, আরামবাগের দেওয়ানবাগী বাবে রহমত দরবার শরিফ প্রাঙ্গণ। আজিমপুর দায়রা শরিফ : প্রতিদিন বাদ মাগরিব হতে এশা পর্যন্ত রাসূল (সা.)-এর শানে দরুদ শরিফ, সালাম, ফাতেহা খানি ও মিলাদ মাহফিল। বিশ্ব জাকের মঞ্জিল : ফরিদপুরে খানকায়ে মুজাদ্দেদীয়া দরবার শরিফে গতকাল সন্ধ্যা থেকে দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা শুরু হয়েছে। তেলাওয়াতে কালাম, মিলাদ মাহফিল, মুরাকাবা মুশাহাদা, জেকের আসকার, বিশেষ মোনাজাত ও খাজাবাবার কবর জিয়ারতের মাধ্যমে আজ কর্মসূচি সমাপ্ত হবে। চট্টগ্রামে জশ্নে জুলুস : পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে প্রায় ২০ লাখ মানুষের সমাগমে আজ চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হবে জশ্নে জুলুস। সকাল ৮টায় ষোলশহর আলমগীর খানকাহ থেকে জুলুস বের হয়ে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থান প্রদক্ষিণ শেষে জামেয়া আহমদিয়া সুনি্নয়া আলিয়া ময়দানে জমায়েত হবে। এ ছাড়া আঞ্জুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুনি্নয়ার আয়োজন ও গাউছিয়া কমিটির সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত জুলুস সমাপ্তি হবে জোহরের নামাজের মধ্য দিয়ে। কাগতিয়া দরবার মাহফিল অনুষ্ঠিত : গতকাল চট্টগ্রামের রাউজানের কাগতিয়া আলিয়া গাউছুল আজম দরবারের ৬০তম জশনে জুলুস ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তব্য দেন অধ্যক্ষ সৈয়দ মুহাম্মদ মুনির উল্লাহ আহমদী, মুফতি মুহাম্মদ ইব্রাহিম হানফি, বদিউল আলম আহমদী, কাজী আনোয়ারুল আলম ছিদ্দিকি ও অধ্যাপক মুহাম্মদ ফোরকান মিয়া।