আসমান ও জমিন সৃষ্টি করার পর আল্লাহ তাআলা মহাজগেক এমন প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন যে, যা সমূলে পরিবর্তন সম্ভব নয়। তাদের পক্ষে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করাও সম্ভব নয়, তাঁর নির্ধারিত নিয়ম পরিবর্তনেরও ক্ষমতা তারা রাখে না। ফলে পৃথিবীতে আল্লাহর নিয়ম ও নির্দেশনায় অনন্তকাল ধরে কোনো পরিবর্তন নেই। বিপরীতে মানুষ আল্লাহর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি হওয়ায় আল্লাহ তাকে কিছু ইচ্ছাধিকার দিয়েছেন।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি তাকে পথের নির্দেশ দিয়েছি, হয় সে কৃতজ্ঞ হবে, না হয় সে অকৃতজ্ঞ হবে।’
(সুরা : দাহর, আয়াত : ৩)
ইচ্ছাধিকার পাওয়া মানুষের সাফল্য নিহিত আছে আসমানি হেদায়েত অনুসরণের মধ্যে। আর আসমানি হেদায়েত কিছু বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আসমানি হেদায়েতের প্রথম উপকরণ পূর্ণ ঈমান, যা সব নেক আমল, সুন্দর কথা ও পছন্দনীয় অবস্থার মূল ভিত্তি।
সমগ্র মানবজীবনে ঈমানের ভূমিকা মানবদেহে হূিপণ্ডের ভূমিকার মতো। হূিপণ্ড সুস্থ থাকলে দেহের বাকি অঙ্গগুলোও সুস্থ থাকবে। ঈমান হলো এমন প্রাণসত্তা, যা মৃতকে প্রাণ দেয়, স্থির বস্তুতে স্পন্দন ও প্রবৃদ্ধি সৃষ্টি করে, ইসলামী জীবনধারার গাড়িতে চলার শক্তি তৈরি করে। ঈমান দোয়া কবুল হওয়া এবং আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্যতা লাভের মাধ্যম।
তা সত্য ও সততার এমন শক্তি, যাতে নদীর ক্ষীপ্রতা, সমুদ্রের উদ্বেল, চমকে দেওয়ার মতো মেঘের গর্জন ও বজ্রপাত লুকিয়ে আছে। এর ভেতর রেশমের নম্রতা, লোহার দৃঢ়তা ও আগুনের উত্তাপ রয়েছে। যখন কারো অন্তরে ঈমান সুদৃঢ় হয়, তখন সে কোনো কিছুর বিনিময়ে তা ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকে না—পৃথিবীর সব অর্থ, সম্পদ, ধন, রত্ন ও উত্কৃষ্ট বস্তু তাকে দিলেও না।
ঈমান যখন মানবসমাজে, গোত্রে ও ঘরে প্রবেশ করে, তখন মানুষ এমন স্বস্তির জীবন লাভ করে, যা বিশ্বাসঘাতকতা, হিংসা-বিদ্বেষ ও ঘৃণা থেকে পবিত্র হয়ে যায়। একইভাবে প্রবৃত্তির অনুসরণ, পরনিন্দা, পরচর্চা, অপবাদ, দোষারোপ ও সীমা লঙ্ঘনের প্রবণতা দূর হয়ে যায়, যা মনুষ্যত্বকে একটি উপযুক্ত ও সুন্দর পোশাক দান করে।
ফলে তার সৌন্দর্য বহুগুণে বেড়ে যায়। পূর্ণিমার চাঁদের মতো তার সৌন্দর্য বিকশিত হয়। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে সেসব গ্রাম্য আরবকে সম্বোধন করেন, যাদের অন্তরে ঈমান পূর্ণতা না পাওয়ায় যারা ইসলামের পরিপূর্ণ সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত ছিল। তিনি বলেন, ‘বেদুইনরা বলে, আমরা ঈমান আনলাম। বলো, তোমরা ঈমান আনোনি, বরং তোমরা বলো, আমরা আত্মসমর্পণ করেছি। কেননা ঈমান এখনো তোমাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি।’
(সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১৪)
সেসব মানুষকে সম্বোধন করে, যাদের অন্তরে ঈমান পৌঁছেনি, যারা শুধু মুখে ইসলাম স্বীকার করে নিয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেন, কান খুলে শুনে নাও! তোমরা সত্যিকার মুমিনের জন্য কষ্টের কারণ হয়ো না, তাদের গায়ে কালিমা লেপন কোরো না, তাদের গোপনীয়তা লঙ্ঘন কোরো না।
ঈমানি শক্তি এমন শক্তি, যখন তা যুদ্ধের ময়দানে প্রবেশ করে, তখন তা কখনো বদর যুদ্ধের অবয়বে আত্মপ্রকাশ করে, কখনো মক্কা বিজয় হয়ে সামনে আসে, কখনো কাদেসিয়া ও ইস্তাম্বুল বিজয়ের রূপ ধারণ করে, কখনো হিত্তিনের জগৎ আলোকিত করে। এভাবে যুগে যুগে তা জাতির ভাগ্যনির্ধারণী যুদ্ধ হয়ে আবির্ভূত হয়। ঈমানি শক্তিতে বলীয়ান যোদ্ধা শত্রুর সংখ্যা, অস্ত্র-উপকরণ ও প্রভাব-প্রতিপত্তির ভ্রুক্ষেপ করে না। তাদের জাগতিক উপকরণগুলো সে গণ্য করে। অবিশ্বাসীদের জয়জয়কার তাকে চিন্তিত করে না। কেননা তার ভেতরে সত্য চিহ্নিত করার এমন যোগ্যতা তৈরি হয়, সত্যই তার কাছে প্রাধান্য পায় এবং সেদিকেই সে পা বাড়ায়। তখন সত্য ও সততার প্রশ্ন তার অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। ফলে সে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করতে দ্বিধা করে না। তার লক্ষ্য থাকে আল্লাহর কালেমা উঁচু করা। কারণ বিজয়ই সত্যের ধর্ম। ঈমানের শক্তিতে বলীয়ান যোদ্ধা বাতিলের জন্য মেঘের গর্জন, শিরক-বিদআতের জন্য বজ্রপাতের মতো ভীতিপ্রদ হয়। সে সব মুমিনের জন্য অন্তরে মমত্ত্ব ও ভালোবাসা লালন করে। সে তাদেরকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে। একজন মুসলমানের জন্য শোভনীয় নয় যে সে অপর মুসলিম ভাইকে আশ্রয়হীন অবস্থায় ছেড়ে দেবে, তার ওপর অবিচার ও সীমা লঙ্ঘন করবে।
আসমানি হেদায়েতের আরেকটি মাধ্যম হলো বিশুদ্ধ জ্ঞান। বিশুদ্ধ জ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো তার মাধ্যমে মানুষ স্বীয় প্রভুকে চিনতে পারে। জ্ঞানান্বেষণ মানুষকে আত্মপরিচয় ও আল্লাহর পরিচয় লাভে সাহায্য করে। নিজের কাজ ও তার পরিণতি সম্পর্কেও সে সচেতন হয়। বিশুদ্ধ জ্ঞান মানুষকে ভালো ও মন্দের, ভালো কাজ ও মন্দ কাজের পার্থক্য বুঝতে সাহায্য করে। একইভাবে তা ঈমানের জ্যোতি ও কুফরের অন্ধকার মানুষের সামনে স্পষ্ট করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আদমকে আল্লাহ যাবতীয় বস্তুর নাম শেখান।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ৩১)
মহান আল্লাহ সর্বপ্রথম আদম (আ.)-এর মাথায় জ্ঞানের মুকুট পরিধান করান। বিশুদ্ধ আসমানির জ্ঞান তাঁকে অন্য সব সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করে। এই জ্ঞানের ভিত্তিতে মহানবী (সা.)-এর মাধ্যমে নবুয়তের ধারা সমাপ্ত করা হয়েছে। সর্বপ্রথম কোরআনের যে আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে তাতেও জ্ঞানের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘পাঠ করো তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন—সৃষ্টি করেছেন মানুষকে আলাক থেকে। পাঠ করো, আর তোমার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যের শিক্ষা দিয়েছেন—শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানত না।’
(সুরা : আলাক, আয়াত : ১-৫)
আল্লাহ তাআলা জ্ঞানচর্চাকে তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন, যেন জ্ঞান উপকারী ও বিশুদ্ধ হয়। একই সঙ্গে তা যেন পথ হারানোর কারণ না হয় এবং তা শিক্ষার্থী, তার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতির কারণ না হয়, যা বর্তমানে খুব বেশি পরিলক্ষিত হয়।
তামিরে হায়াত থেকে আলেমা হাবিবা আক্তারের ভাষান্তর
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন