হজরত আইয়ুব আনসারী (রা.)-র বাসভবনে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বান্দার হক সম্পর্কে যে বক্তব্য রাখেন তা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অবশ্য পালনীয়। আল্লাহর হাম্দ ও সানা বর্ণনা করার পর তিনি উপস্থিত মুসল্লিদের উদ্দেশ করে বলেন- হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি যে, তোমরা আল্লাহতায়ালার এবং তাঁর বান্দাদের হক আদায় কর। তোমরা কি জান, বান্দার হক কী? স্মরণ রেখ, প্রত্যেক মুসলমানের চারটি হক রয়েছে : অসুস্থ হলে তার শুশ্রূষা করা, বিপদে তার সাহায্য করা, মৃত্যু হলে তার দাফন-কাফনে শরিক হওয়া ও সাহায্য চাইলে সাহায্য দান করা। যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ, কোনো লোক ততক্ষণ পর্যন্ত মুসলমান হতে পারে না যতক্ষণ না সে তার নিজের জন্য যা পছন্দ করে তার ভাইয়ের জন্যও তাই-ই পছন্দ করে।
হে মুসলমানগণ! যতদূর সম্ভব নিজের ভাইদের সাহায্য কর। একে অপরের ওপর জুলুম কর না। অপরের মাল অবৈধভাবে আত্দসাৎ কর না, একে অপরের অসম্মান কর না। মনে রেখ, যার সন্তান জন্মলাভ করবে তার উচিত হবে সন্তানের ভালো নামকরণ করা, তার তা'লিম-তরবিয়াতের জন্য প্রচেষ্টা করা এবং সাবালক হলে তার শাদির ব্যবস্থা করা এবং কোনো রুসুম-রেওয়াজের খাতিরে শাদিদানে বিলম্ব না করা। কেননা অবিবাহিত অবস্থায় বালেগ ব্যক্তি কোনো গুনাহ করলে তার জিম্মাদারি পিতার হবে। সন্তানকে আদব, বুদ্ধি-বিবেচনা এবং আচার-আচরণ শিক্ষা দেওয়া জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্যের অন্যতম। হে মুসলমানগণ! তোমাদের সন্তানদের সাত বছর বয়সে সালাতের তাগিদ কর এবং দশ বছর বয়সে কঠোর শাসন কর এ জন্য যে, সালাত এক মহান ইবাদত। যে ব্যক্তি আন্তরিকতার সঙ্গে সালাত আদায় করে তার রূহ আলোকোজ্জ্বল হয়। সে আল্লাহর খাতিরে আল্লাহ ব্যতীত যাবতীয় সম্পর্ক পরিত্যাগ করে। নিজের সম্পূর্ণ শক্তিসহকারে আল্লাহর পছন্দনীয় কাজে মশগুল হয়ে যায়। নিজের মাল মিশকিন ও অসহায়দের জন্য ব্যয় করে। মুসিবতকালে সবর ও দৃঢ়তা প্রদর্শন করে এবং সুখের সময় আল্লাহর শোকর আদায় করে।
হে উপস্থিত জনমণ্ডলী! তোমাদের রব বলেন : প্রতিবেশীর সঙ্গে উত্তম ব্যবহার কর এবং তাদের কষ্ট দিও না। যে প্রতিবেশীদের কষ্ট দেয় তার জন্য লাঞ্ছনাকারী আজাব রয়েছে। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, যার অনিষ্ট থেকে প্রতিবেশীরা নিরাপদ নয় সে জান্নাতে দাখিল হতে পারবে না। সে মু'মিন নয়, যে তৃপ্তির সঙ্গে আহার করে অথচ তার প্রতিবশী উপোস থাকে। প্রতিবেশীদের মধ্যে নিকটতম গৃহের লোক তোমার সাহায্য পাওয়ার অধিক হকদার। তোমরা কী জান, প্রতিবেশীর সীমা কতদূর? মনে রেখ, চল্লিশ ঘর সামনে, চল্লিশ ঘর পেছনে, চল্লিশ ঘর ডানে ও চল্লিশ ঘর বামে যারা আছে সবাই প্রতিবেশীর অন্তর্ভুক্ত। তোমার প্রতিবেশী ভুখা রয়েছে জানতে পারলে তাকে তোমার নিজের খাবার থেকে কিছু দাও। তোমার ঘরে সুরউয়া রান্না হলে তাতে পানি বেশি করে দাও এবং তা প্রতিবেশীদের মধ্যে বণ্টন কর। যে ব্যক্তি সারা দিন সালাত আদায় করে ও সিয়াম পালন করে এবং সারা রাত ইবাদত করে অথচ তার চরিত্র উত্তম নয় এবং তার প্রতিবেশী তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ নয়, সে ব্যক্তি দোযখী হবে। যে ইবাদত করে, উন্নত চরিত্রের অধিকারী এবং তার প্রতিবেশী তার অনিষ্ট থেকে মুক্ত, সে অবশ্যই জান্নাতী হবে।
হে উপস্থিত জনতা! সন্তানের ওপর পিতা-মাতার হক রয়েছে। তোমাদের রব বলেন : আমি ছাড়া কারও ইবাদত কর না, মাতা-পিতার সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার কর, তারা বৃদ্ধ হলে তাদের সামনে 'উহ্' পর্যন্ত বল না; তাদের সঙ্গে কঠোর ভাষায় কথা বল না, আদবের সঙ্গে আস্তে আস্তে কথা বল; তাদের জন্য দু'আ কর : হে রব, তারা যেভাবে আমাকে লালন-পালন করেছেন এবং আমার ওপর রহম করেছেন ঠিক সেভাবে তুমিও তাদের ওপর রহম কর।
হে মানুষ! মাতা-পিতার আনুগত্য করা এবং তাদের আরাম দেওয়ার চেষ্টা করা আল্লাহর কাছে প্রিয়তম আমল। আমি তোমাদের অবহিত করছি, আল্লাহর সন্তুষ্টি বাপের সন্তুটির সঙ্গে এবং আল্লাহর ক্রোধ বাপের ক্রোধের সঙ্গে জড়িত। উদ্দেশ্য হলো : মাতা-পিতা সন্তুষ্ট হলে আল্লাহও সন্তুষ্ট এবং তারা অসন্তুষ্ট হলে আল্লাহও অসন্তুষ্ট। আমার খুব স্মরণ রয়েছে যে, একবার দামেস্কের এক নওজোয়ান আমার কাছে এসেছিল। সে বলল, 'হিজরত করার জন্য আপনার কাছে বায়'আত করতে এসেছি অথচ আমার পিতা-মাতাকে অশ্রুপ্লাবিত অবস্থায় রেখে এসেছি। আমি তাকে বললাম, তোমার জন্য এটাই হিজরত। কেননা মাতা-পিতার মনের সন্তুষ্টি বিধান মহান পুরস্কারের যোগ্য। যে মাতা-পিতার সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করে তার জন্য দুনিয়া ও আখেরাতেও উত্তম ব্যবহার রয়েছে। যে পিতা-মাতার সঙ্গে মন্দ ব্যবহার করে তার জন্য দুনিয়া ও আখেরাতেও মন্দ ব্যবহার রয়েছে। আমি পুনরায় তোমাদের নসিহত করছি যে, মাতা-পিতার সম্মান কর এবং তাদের খিদমত কর।
আসসালামু আলাইকুম।
-মাওলানা মুহম্মাদ জিয়াউদ্দিন