কোরবানি করা আল্লাহর এক ইবাদত। সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির জন্য প্রিয় পোষা প্রাণীকে কোরবানী করা। আর কিতাব ও সুন্নাহ দ্বারা এ কথা প্রমাণিত যে, কোন আমল নেক বা ভাল হয় না, কিংবা গৃহীত হয় না; যতক্ষণ না তাতে প্রাথমিকভাবে ( যা অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত) দুটি শর্ত পূরণ হয়েছে:
প্রথমত : ইখলাস, অর্থাৎ তা যেন খাটি আল্লাহরই উদ্দেশ্যে হয়। তা না হলে তা আল্লাহর নিকটে কবুল হবে না। যেমন : কাবীলের নিকট থেকে কোরবানি কবুল করা হয়নি এবং তার কারণ স্বরূপ হাবীল বলেছিলেন, আল্লাহ তো মুত্তাক্বীদের (পরহেযগার ও সংযমী) কোরবানিই কবুল করে থাকেন। [ সূরা মায়িদা (৫):২৭]।
এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, আল্লাহর কাছে ওগুলোর (কোরবানির পশুর) না গোশত পৌঁছে, না রক্ত পৌঁছে বরং তার কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি ওগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে পার এজন্য যে, তিনি তোমাদেরকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন, কাজেই সৎ কর্মশীলদেরকে তুমি সুসংবাদ দাও। [সূরা হজ (২২):৩৭]
দ্বিতীয়ত : তা যেন আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.)-এর নির্দেশিত বিধি-বিধান অনুযায়ী হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে। [সূরা কাহফ:১১০]।
সুতরাং যারা কেবল বেশি করে গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে কোরবানি দেয় অথবা লোক সমাজে নাম কুড়াবার উদ্দেশ্যে মোটা-তাজা অতিরিক্ত মূল্যের পশু ক্রয় করে এবং তা প্রদর্শন ও প্রচার করে থাকে তাদের কোরবানি যে ইবাদত নয়- তা বলাই বাহুল্য।
এছাড়া বাহ্যিকভাবে কোরবানি শুদ্ধ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে:
শর্ত-০১ : এমন পশু দ্বারা কোরবানি দিতে হবে যা শরীয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। অর্থাৎ কোরবানির পশু যেন সেই শ্রেণি বা বয়সের হয় যে শ্রেণি ও বয়স শরীয়ত নির্ধারিত করেছে। সেগুলো হলো উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা। এগুলোকে কুরআনের ভাষায় বলা হয় বাহীমাতুল আনআম। যেমন এরশাদ হয়েছে- আমি প্রত্যেক সম্প্রদাযের জন্য কোরবানির নিয়ম করে দিয়েছি; এবং তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর উপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। [সূরা হজ্জ্ব(২২):৩৪]
হাদিসে আছে- তোমরা অবশ্যই নির্দিষ্ট বয়সের পশু কোরবানি করবে। তবে তা তোমাদের জন্য দুষ্কর হলে ছয় মাসের মেষ-শাবক কোরবানি করতে পার। [মুসলিম, হাদিস নং ১৯৬৩]।
আর আল্লাহর রাসূল (সা.) উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ছাড়া অন্য লোক জন্তু কোরবানি করেননি ও কোরবানি করতে বলেননি। তাই কোরবানি শুধু এগুলো দিয়েই করতে হবে। ইমাম মালিক (রহ.) এর মতে কোরবানির জন্য সর্বোত্তম জন্তু হলো শিংওয়ালা সাদা-কালো দুম্বা। কারণ রাসূলে কারীম (সা.) এ ধরনের দুম্বা কোরবানি করেছেন বলে সহিহ বুখারি ও মুসলিম হাদিসে এসেছে। অধিকাংশ উলামাদের মতে, সবচেয়ে উৎকৃষ্ট কোরবানির পশু হলো উট, অতঃপর গরু, তারপর মেষ (ভেড়া), তারপর ছাগল। আবার নর মেষ মাদী মেষ অপেক্ষা উত্তম। (আযওয়াউল বায়ান, ৫/৬৩৪)।
একটি উট ও গরু-মহিষে সাত ব্যক্তি কোরবানির জন্য শরীক হতে পারে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১৩১৮)। অন্য এক বর্ণনামতে, উট কোরবানিতেও দশ ব্যক্তি শরীক হতে পারে। ইমাম শাওকানী বলেন, হজ্জের কোরবানিতে দশ এবং সাধারণ কোরবানিতে সাত ব্যক্তি শরীক হওয়াটাই সঠিক। (নায়লুল আওত্বার, ৮/১২৬)
যেমন হাদিসে আছে- আমরা হুদাবিয়াতে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাথে ছিলাম। তখন আমরা উট ও গরু দ্বারা সাত জনের পক্ষ থেকে কোরবানি দিয়েছি। (ইবনে মাজা-৩১৩২)।
শর্ত-০২ : শরীয়তের দৃষ্টিতে কোরবানির পশুর বয়সের দিকটা খেয়াল রাখা জরুরি। উট পাঁচ বছরের হতে হবে। গরু বা মহিষ অন্তত দু'বছরের হতে হবে। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা হতে হবে এক বছর বয়সের। অবশ্য অসুবিধার ক্ষেত্রে ছয় মাস বয়সী মেষ কোরবানি করা যায় । প্রিয় নবী (সা.) বলেন, দাতালো ছাড়া জবেহ করো না। তবে তা দুর্বল হলে ছয় মাসের মেষ জবেহ কর। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১৯৬৩)। কিন্তু উলামাগণ এ বিষয়ে একমত যে, ছমাস বয়সী মেষের কোরবানি সিদ্ধ হবে; তা ছাড়া অন্য পশু পাওয়া যাক অথবা না যাক। অধিকাংশ উলামাগণ ওই হাদিসের আদেশকে ইস্তিহবাব (উত্তম) বলে গ্রহণ করেছেন এবং বলেছেন যে, ওই হাদিসের মর্মার্থ এটা নয় যে, অন্য কোরবানির পশু পাওয়া না গেলে তবেই ছমাস বয়সের মেষ শাবকের কোরবানি বৈধ। যেহেতু এমন অন্যান্য দলীলও রয়েছে যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ওই বয়সী মেষেরও কোরবানি বৈধ; প্রকাশ থাকে যে, যদিও কোরবানিদাতা অন্য দাতালো পশু পেয়ে থাকে। যেমন রাসূল (সা.) বলেন, ছমাস বয়সী মেষশাবক উত্তম কোরবানি। (মুসনাদে আহমাদ, ২/৪৪৫; তিরমিযী) উক্ববা বিন আমের (রা.) বলেন, (একদা) নবী (সা.) কোরবানির পশু বিতরণ করলেন। উক্ববার ভাগে পড়ল এক ছমাসের মেষ। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার ভাগে ছমাসের মেষ হলো? প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, এটা দিয়েই তুমি কোরবানি কর। (সহিহ বুখারি , হাদিস নং ২১৭৮; সহিহ মুসলিম, ১৯৬৫)।
শর্ত-০৩ : কোরবানির পশু যাবতীয় দোষ-ত্রুটি মুক্ত হতে হবে। যেমন হাদিসে এসেছে : সাহাবী বারা ইবনে আযেব (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন তারপর বললেন, চার ধরনের পশু, যা দিয়ে কোরবানি জায়েয হবে না। অন্ধ. যার অন্ধত্ব স্পষ্ট, রোগাক্রান্ত; যার রোগ স্পষ্ট, পঙ্গু; যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট এবং আহত; যার কোন অঙ্গ ভেঙে গেছে। নাসাঈর বর্ণনায় আহত শব্দের স্থলে পাগল উল্লেখ আছে। (তিরমিজি-১৫৪৬; নাসাঈ-৪৩৭১; আবূদাউদ; হাদিসটি সহিহ)। অতএব এ চারের কোন এক ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারা কোরবানি সিদ্ধ হয় না।
শর্ত-০৪ : যে পশুটি কোরবানি কারা হবে তার উপর কোরবানিদাতার পূর্ণ মালিকানা সত্ত্ব থাকতে হবে। অর্থাৎ কোরবানিদাতা যেন বৈধভাবে ওই পশুর মালিক হয়। সুতরাং চুরিকৃত, আত্মসাৎকৃত, বন্ধকী পশু, কর্জ করা পশু বা পথে পাওয়া, অবৈধ ক্রয়-বিক্রয়ে ক্রীত পশু দ্বারা কোরবানি আদায় হবে না। একই ভাবে অবৈধ মূল্য যেমন সুদ, ঘুষ, প্রবঞ্চনা, ধোঁকা প্রভৃতির অর্থ দ্বারা কেনা পশুর কোরবানি জায়েয নয়। যেহেতু কোরবানি এক ইবাদত যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা হয়। আর পাপ করার মাধ্যমে কোন প্রকার নৈকট্য লাভ সম্ভব নয়। বরং তাতে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। রাসূল (সা.) বলেন, আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্র ব্যতিত কিছু গ্রহণ করেন না। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১০১৫)।
লেখক : ড. মো. আবদুল কাদের, সম্পাদনায় : ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
বিডি-প্রতিদিন/০৫ অক্টোবর ২০১৪/ আহমেদ