ভোগবাদের সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়া নাগরিক জীবনে মানুষের ব্যস্ততার যেন শেষ নেই। এ কাজে সে কাজে সারাটা দিন থাকতে হয় দৌঁড়ের ওপর। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে নানা কারণে আমাদের ওপর ভর করে নানা মানসিক চাপ। বিরতিহীন খাটুনি ও পরিশ্রমের ফলে আমাদের মনোজগতে তৈরি হয় স্ট্রেস বা মানসিক চাপ। এই চাপ একসময় মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে জীবনের পরতে পরতে। ছোট্ট এই জীবনটাকে উপভোগ করার আগেই বিষাদে ভরে ওঠে মন।
কিন্তু আর কতদিন এভাবে চলা সম্ভব। দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততা থেকে হয়তো বের হয়ে আসা সম্ভব নয়। কিন্তু তারপরও কিছু পন্থা অবলম্বন করে কিছুটা হলেও মানসিক চাপ কমানো সম্ভব।
বিরতি নিন : যত যাই হোক চেষ্টা করবেন একসঙ্গে একের বেশি কাজ না করতে। যদি কাজের ফাঁকে ফাঁকে অন্তত ১০/১৫ মিনিটের বিরতি নেয়ার চর্চাটা করতে পারেন আপনি আপনার কাজে খুব ভালো দক্ষতা দেখাতে পারবেন। একইসাথে মানসিক চাপ কিছুটা কমবে।
গভীর শ্বাস নিন : মানসিক চাপে যখন আপনি বিপর্যস্ত, এদিকে হাতে সময়ও নেই। এ সময় চাপ কমাতে চোখ বন্ধ করে গভীর একটা শ্বাস নিন। এতে ‘কর্টিসল’ জাতীয় চাপের হরমোন ধ্বংস হয়ে যাবে। শরীরে বেড়ে যাবে অক্সিজেনের প্রবাহ। কমবে মানসিক চাপ। মুহূর্তেই আপনি নিজেকে হালকা অনুভূব করবেন।
'না' বলতে শিখুন : কাজের চাপ এবং সমাজ ও পরিবারকে দেওয়া অঙ্গীকার যখন বেশি হয়ে যায়, তখন 'না' বলাটা শিখুন। অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে যেয়ে সেধে চাপ নিতে যাবেন না। প্রয়োজনে সাহায্যও চেয়ে নিতে পারেন, এটিও টিম ওয়ার্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
গলা ছেড়ে গেয়ে উঠুন : প্রিয় গান মানুষের মানসিক চাপ কমাতে ভূমিকা রাখে। নানা ব্যস্ততার কারণে আপনি যখন মানসিক চাপ ও শারীরিকভাবে অবসাদগ্রস্ত তখন গলা ছেড়ে গেয়ে উঠুন প্রিয় কোনো গান। গান গাইতে হলে ভালো শিল্পী হতে হবে- এমন কোনো নিয়ম নেই। প্রত্যেক মানুষই তার প্রিয় গান গুনগুন করে গায়। এ জন্যই মানসিক চাপ কমাতে গাইতে থাকুন পছেন্দের কোনো গান। মুক্ত গলায় গান করার সময় মানুষের শরীরে কিছূ হরমোন তৈরি হয় । যা মানসিক চাপ কমিয়ে দেয়।
ঘুমাতে চেষ্টা করুন : মানসিক যন্ত্রণাটা কিছুতেই না কমলে ঘুমাতে চেষ্টা করুন। নিরব কিছু সময় হয়তো আপনার সমস্যাটাকে সহজভাবে চিন্তা করার সুযোগ করে দেবে। মানসিক চাপের একটি অন্যতম পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হল ইন্সোমোনিয়া (ঘুম না আসা রোগ), এটি মানসিক চাপকে আরও বাড়িয়ে তোলে এবং শরীরকে ক্লান্ত ও মেজাজকে খিটখিটে করে তোলে। টেলিভিশান বন্ধ করে দিন, উষ্ণ গরম পানিতে গোসল করে নিন।
ব্যায়াম করুন : মানসিক চাপ ঝেড়ে ফেলার একটি দুর্দান্ত উপায় হচ্ছে ব্যায়াম। শারীরিক পরিশ্রম আমাদের শরীরে এন্ডোর্ফিনের নিঃসরণ ঘটায়, যা আমাদের মনে ভাল লাগার অনুভূতি তৈরী করে। একই সাথে তা আবার এনার্জি বাড়ায় এবং স্ট্রেস হরমোন যেমন কর্টিসোলকেও প্রতিহত করে। আপনার দেহের উপযোগী যেকোনো একটি ব্যায়াম নির্বাচন করে নিন, হতে পারে সেটি হাঁটা কিংবা নাচ কিংবা জিমের ব্যায়াম।
মেডিটেশন করুন : দিনে অন্তত ১৫ থেকে ৩০ মিনিটের জন্যে হলেও মেডিটেশন করুন। কাজের চাপে আপনি খুব ব্যস্ত থাকলেও মেডিটেশনের জন্য একটু সময় রাখুন। মেডিটেশন করতে হলে আপনার দরকার হবে শুধুই আপনার মন। দিনে কিছুটা সময় নিজের মনটাকে একটু নীরবতা দিন অথবা শ্বাসপ্রশ্বাসের দিকে মনোযোগ দিন। একটুখানি মনের শান্তিই সারাদিন আপনাকে অসংখ্য চাপ আর অশান্তি মোকাবিলা করার শক্তি দেবে।
ইতিবাচক হোন : অধিকাংশ মানসিক চাপই আসলে মানুষের অনুধাবনের ওপর নির্ভর করে। একটু পেছনে ফিরে তাকান এবং ভাবুন, সত্যিই যা নিয়ে উদ্বিগ্ন, তা নিয়ে খুব চিন্তা করার দরকার আছে কি? শুধু দৃষ্টিভঙ্গির একটু পরিবর্তনই যেকোনো সমস্যাকে একটি ইতিবাচক কোণ থেকে দেখতে সাহায্য করবে।
পরিকল্পনাই সব : সময় ব্যবস্থাপনায় কৌশলী হোন। একদিনের কাজ শেষে পরের দিন 'কী করতে হবে' তার একটি তালিকা তৈরি করে রাখুন। তালিকাবদ্ধ কাজগুলো একটি একটি করে শেষ হওয়ার পর তা আপনাকে স্বস্তির আবেশ দেবে।
মুক্তির পথ খুঁজে নিন : আপনার নিত্য যেসব বিষণ্ণতা, সেগুলো থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য নিয়মিত একটি মুক্তির পথ খুঁজে নিন, মানসিক চাপ দূর করার ক্ষেত্রে তা অনেক কাজে দেবে। হতে পারে তা কোন সামাজিক অনুষ্ঠান, গান, নাচ, কিংবা ধ্যান, প্রার্থনা কিংবা কোন শখের কাজ। এটি আপনাকে মানসিক শক্তি দেবে এবং উপভোগ্য করে তুলবে আপনার এক একটি বিষাদময় দিন।
অ্যারোমাথেরাপি : কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রশ্বাস গ্রহণের ফলে তৎক্ষণাৎ মানসিক চাপ দূর হয়ে যায় এবং পাশাপাশি দুশ্চিন্তা কমে গিয়ে মনোযোগ বেড়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, সুগন্ধি আমাদের ইন্দ্রিয় ব্যবস্থায় উদ্দীপনা সৃষ্টি করে, যা মস্তিষ্কে এমন কিছু রাসায়নিক পদার্থের নিঃসরণ ঘটায়, যা আমাদের মধ্যে শিথিলায়ন, ভালবাসা, উত্তেজনা ও শান্তির অনুভূতি সৃষ্টি করে। মানসিক চাপ নির্মূলে কয়েকটি জনপ্রিয় সুগন্ধি তেল হচ্ছে রোজমেরি, সাইপ্রেস ও ল্যাভেন্ডার।
ডাক্তারের পরামর্শ নিন : অস্থিরতা যদি বাড়তে থাকে, মানসিক চাপ যদি আঁকড়ে ধরে তবে শুধু শুধু নিজের সঙ্গে না লড়ে কোনো ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলুন।
খামোখা চাপ নিয়ে জীবনটাকে কেন কষ্ট দেবেন? মনের শান্তিতেই আসল শান্তি। তাই যথাসম্ভব চাপমুক্ত থেকে জীবন নির্বাচ করার চেষ্টা করুন।
বিডি-প্রতিদিন/ ১৭ মার্চ ২০১৫/শরীফ