দেশে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সর্বস্তরের নাগরিক উদ্বিগ্ন। ৬ জানুয়ারি অবরোধ কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত জানমালের যে ক্ষতি হয়েছে তা অকল্পনীয়। প্রাণ গেছে ২৩ জনের। আহত হয়েছেন অনেক। সরকার ও ২০-দলীয় জোট যে অনড় অবস্থান নিয়েছে তাতে অর্থনীতির গতি প্রায় স্থবির হয়ে পড়ছে। এ পরিস্থিতি থেকে দেশকে বের করে আনার উপায় কী? এই প্রশ্ন দেশবাসীকে অস্থির করে তুলেছে। কারণ নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে উন্নতির ধাপে ধাপে এগিয়ে দেশটি যখন বিশ্বসভায় মধ্যম আয়ের দেশগুলোর তালিকাভুক্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, তখন সংঘাত-সংঘর্ষ-সহিংসতা জাতীয় অগ্রযাত্রাকে থমকে দিতে চাইছে। এ অবস্থা বেশিদিন চলতে দেওয়া আর আত্মহত্যা করা একই কথা বলে মনে করছেন সমাজহিতৈষীরা। তা না হলে সমাধানের পথ কী? এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর কাছে সুচিন্তিত অভিমত ব্যক্ত করেছেন দেশের বিশিষ্ট দুই অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ও খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জুলকার নাইন ও মানিক মুনতাসির
সমঝোতা ও আলোচনাই পথ : ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
সমসাময়িক সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিধারা কেমন এবং চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতি অর্থনীতির জন্য কতটা স্বস্তিদায়ক?
রাজনৈতিক অস্থিরতা কোনো দেশের জন্যই কাম্য নয়। উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ অত্যন্ত জরুরি। সেই সঙ্গে থাকতে হবে সুশাসন। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা মোটামুটি গতিতে এগিয়ে যাচ্ছি। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মোটামুটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল। অর্থনীতিতেও একটা গতি ছিল। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনের পর থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে গেছে, যা দেশের অর্থনীতির স্বাভাবিক গতিকে বাধাগ্রস্ত করেছে। আর বর্তমানে রাজনীতিতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। এটা চরম অস্বস্তিদায়ক। শুধু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডই নয়, সব ক্ষেত্রেই এটা অস্বস্তি সৃষ্টি করেছে। এটা এর আগে কখনো ছিল না। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সমঝোতা এবং আলোচনাই একমাত্র পথ। অন্যথায় তৃতীয় কোনো শক্তি আবারও ক্ষমতায় আসবে। সেটারও মাশুল দিতে হবে জনগণকেই।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে সর্বশেষ ৫ জানুয়ারির আগের এক বছরের মূল্যায়ন করবেন কীভাবে?
এ সময়ে রুটিনওয়ার্ক হয়েছে। নতুন করে কোনো পরিকল্পনা বা উন্নয়ন সাধিত হয়নি। দৃশ্যমান যা হয়েছে এগুলো আগের পরিকল্পনার অংশ। এমনকি এগুলোর কাজ আগেই শুরু হয়েছিল। এককথায় বলা যায়, গত এক বছরে সাদামাটা অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এটাকে টেকসই উন্নয়ন বলা যায় না। কারণ টেকসই উন্নয়নের প্রধান শর্ত হচ্ছে সুশাসন থাকতে হবে। অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। কিন্তু এর কোনোটাই হয়নি। তবে এর মধ্যেও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।
দেশে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসনের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু?
দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের জন্য অবশ্যই স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ দরকার। আর টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সুশাসন। ফলে স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসনের কোনো বিকল্প নেই। রাজনৈতিক দল, সরকারি প্রতিষ্ঠান, সরকারি কর্মকাণ্ড, আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগকারী সংস্থা সবগুলোর মধ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
রাজনৈতিক মতবিরোধে সৃষ্ট সহিংস পরিস্থিতিতে কোন কোন খাত সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে আপনার ধারণা?
এমন সহিংসতা ও অচলাবস্থার জন্য অর্থনীতির সব খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে পরিবহন, কৃষি, গার্মেন্ট এসব খাতের ক্ষতিটাই বেশি। বিদেশি বিনিয়োগের যেসব খাত রয়েছে সেগুলোও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তার মানে কিন্তু এই নয় যে অন্য খাতে একেবারেই ক্ষতি কম হচ্ছে। আর এ অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের সব ধরনের গতিশীলতা বন্ধ হয়ে যাবে।
হরতাল-অবরোধ বন্ধে আইন করতে হবে ব্যবসায়ীদের এই দাবির প্রেক্ষিতে আপনার মূল্যায়ন কি?
আইন করে হরতাল বন্ধ করতে ব্যবসায়ীরা যে দাবি তুলেছেন সেটা যুক্তিযুক্ত। কিন্তু আইন করে তো সবকিছু বন্ধ করা যায় না। এই যেমন চোরাগোপ্তা হামলা সেটা কি আইন দ্বারা বন্ধ করা সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন আলোচনা। তবে এ বিষয়ে সবপক্ষের বক্তব্য আসতে হবে। বিশেষ করে সরকার, বিরোধী দল, সংসদের অন্যান্য দল এবং সর্বসাধারণের দাবি আসতে হবে। এর চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এটা চান কিনা- সেটা দেখতে হবে। কেননা হরতালের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। কর্মজীবীরা। এদের মতামতই মূল বিষয়।
রাজনীতিতে এ অচলাবস্থায় দুই দলের রাজনৈতিক অবস্থানকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন এবং পরিস্থিতি উত্তরণে আপনার পরামর্শ কি?
এখানে একটা বিষয় হচ্ছে আপনি সমাধান চান কিনা- যদি চান তাহলে সম্ভাব্য পথ যেটা আছে, সেটাই গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। সরকার আসলে এটা চায় কিনা, চাইলে আলোচনা করতে হবে। প্রধান দুই দলের মধ্যেই তো সমস্যা, অতএব তাদের চাহিদাটা কী? সেটা বুঝতে হবে। আর জনগণ কি চায়। দেশের জন্য কি প্রয়োজন, এসব বিষয় আমলে নিয়ে আলোচনা করলে সমাধান বের করে আনা সম্ভব। দুই দলই যে অনড় অবস্থানে রয়েছে সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
বড় ব্যবসায়ীরা তো সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন বলে সরকার ঘোষণা দিয়েছে। যারা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তাদের কথা কেউ বলে না। ফলে তাদের একটা দাবি তুলতে হবে। তাদের জনমত সৃষ্টির জন্য আমাদের যে সুশীল সমাজ আছে তারা কাজ করতে পারেন। এক্ষেত্রে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা সরকার বা বিরোধী দলের কাছে তাদের দাবিগুলো তুলে ধরবেন। এভাবে ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব।
*অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
সমাধানের দু'টো পথই দেখতে পাই : খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
সমসাময়িক সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিধারা কেমন এবং চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতি অর্থনীতির জন্য কতটা স্বস্তিদায়ক?
মৌল সূচকগুলো বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিধারা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ভালো, প্রত্যাশিত পর্যায়ে আমদানি-রপ্তানি, মূল্যস্ফিতি নিম্নগামী- অর্থাৎ সার্বিক বিবেচনায় সূচকগুলোর সবই সুস্থ ধারায় আছে। অন্যদিকে, চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতি অর্থনীতির জন্য স্বস্তিদায়ক নয় এটা সত্য, তবে অল্প কয়েকদিনের এই অস্থিতিশীলতা বিবেচনায় নিয়ে অর্থনীতির প্রক্ষেপণ সম্ভব নয় এবং তা সঙ্গতও নয়। গত বছরের ৫ জানুয়ারির পরও এ ধরনের সহিংসতা হয়েছে। কিন্তু সেই পরিস্থিতি প্রলম্বিত হয়নি। খুব তাড়াতাড়ি হয়তো এবারের পরিস্থিতিরও উত্তরণ হয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। কারণ সব সময়ই আমাদের নিজস্ব কিছু পদ্ধতিতে সংকটের তাৎক্ষণিক সমাধান করে আমরা বেরিয়ে এসেছি।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে সর্বশেষ ৫ জানুয়ারির আগের এক বছরের মূল্যায়ন করবেন কিভাবে?
অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বছরটি ছিল স্থিতিশীল। এ সময় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অব্যাহত ছিল, ব্যাংকের টাকা বিনিয়োগ হয়েছে, সুদের হার কমেছে, রেমিট্যান্স প্রবাহ ধনাত্মক ছিল। টেকসই অবস্থার কারণেই অগ্রসর অর্থনীতি আরেকটি বছর কাটিয়েছে।
দেশে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসনের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু?
বিনিয়োগের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসন দুটোরই প্রয়োজনীয়তা খুবই বেশি। যেহেতু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বিষয়টি আমাদের আওতার বাইরে, সেহেতু এ বিষয়ে কমেন্ট করব না। তবে আশা করব, যাদের দায়িত্ব তারা একটি স্থায়ী সমাধানে আসবেন। তবে সুশাসনের ক্ষেত্রে যেমন দুর্নীতি কমিয়ে আনা, ব্যাংক ঋণের অব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন এবং এটি সম্ভব বলে আমি মনে করি। তাহলে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন অপেক্ষাকৃত সহজ হবে।
রাজনৈতিক মতবিরোধে সৃষ্ট সহিংস পরিস্থিতিতে অর্থনীতির কোন কোন খাত সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে আপনার ধারণা।
বিশেষ বিশেষ কোন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না। আবার সমসাময়িক কোনো ঘটনায় অর্থনীতির বিচার উচিতও নয়। কারণ দুই-চারদিন পরই হয়তো এ পরিস্থিতি আর থাকবে না। তখন আবার আগের পরিবেশ বিরাজ করবে। অন্য নানান পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। আর বাংলাদেশের এ পরিস্থিতি আজ নতুন নয়। এ ধরনের সহিংসতা ও অস্থিরতার মধ্যেই বছরের পর বছর আমাদের অর্থনীতি টিকে আছে। সব সময় নিজস্ব কিছু পদ্ধতিতে সমস্যা কাটিয়ে এসেছে। এটাও বলা যায় না, এ ধরনের অবস্থা হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ যে দুই রাজনৈতিক পক্ষের মধ্যে বিরোধ তা আদর্শগত। বিরোধ স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে। বিএনপি স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবিরকে ত্যাগ না করা পর্যন্ত এই দুই পক্ষের মধ্যে কোনো কার্যকর সমঝোতা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি না।
হরতাল-অবরোধ বন্ধে আইন করতে হবে ব্যবসায়ীদের এ দাবির প্রেক্ষিতে আপনার মূল্যায়ন কি?
আমি এই দাবির সঙ্গে একমত নই। কারণ হরতাল ও সহিংসতা-সন্ত্রাস এক বিষয় নয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হরতাল হতেই পারে। তবে সন্ত্রাস-সহিংসতা কাম্য নয়। সন্ত্রাস বন্ধ করতে হবে। এর জন্য যা করার করতে হবে। সে জন্য যে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে।
রাজনীতিতে যে অচলাবস্থা দুই দলের রাজনৈতিক অবস্থানকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন এবং পরিস্থিতি উত্তরণে আপনার পরামর্শ কি?
দুই রাজনৈতিক দলের অবস্থান এখন উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরুতে। একদিকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী দল আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার চেতনা দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে যাচ্ছে। অন্যদিকে স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে জোট গড়ে অবস্থান করছে বিএনপি। এ অবস্থায় কোনো সংলাপ হওয়ার নয়, হলেও টেকসই কোনো সমাধান সেখানে আসবে না। আমি পরিস্থিতির উত্তরণে দুটো পথই দেখতে পাই। এক. রাজনীতি থেকে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের পরিত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক নীতিগুলো মেনে নেওয়া এবং সন্ত্রাস-সহিংসতার পথ ত্যাগ করে পরিচ্ছন্ন গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে আসা। দুই. পঁচাত্তরে যেমন অস্ত্রের ঝনঝনানি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তিকে নির্মূল করা হয়েছিল তেমন করা। এখন সিদ্ধান্ত জনগণই নেবে তারা কোন পথে যাবে।
* অর্থনীতিবিদ ও কৃষি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান