আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। দেশের বিরাজমান সংকটকালে আমাদের বক্তব্য ও দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করছি। ইতিপূর্বে আমরা চলমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে দেশের অভিভাবক হিসেবে মাননীয় রাষ্ট্রপতিকে সব পক্ষের সঙ্গে সংলাপের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলাম। দেশের অন্যান্য বিশিষ্ট নাগরিকদেরও কেউ কেউ রাষ্ট্রপতিকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু মাননীয় রাষ্ট্রপতি সংকট উত্তরণে এখন পর্যন্ত কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। অথচ রাজনৈতিক সংকট ক্রমেই জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। ক্ষমতার রাজনীতির প্রতিহিংসার আগুনে প্রতিদিন দগ্ধ হচ্ছে সৃষ্টিরসেরা আদম সন্তান। জননিরাপত্তা ভেঙে পড়েছে। উন্নয়ন-উৎপাদন, অর্থনীতি থমকে দাঁড়িয়েছে। হুমকিতে পড়েছে জাতীয় শিক্ষা ও চিকিৎসাব্যবস্থা। এমনকি রাজনৈতিক সংকট জনজীবনকে এতটাই জিম্মি ও অসহায় করে তুলেছে যে, দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ অর্ধাহারে ও অনাহারে জীবন-যাপন করছে। অপরদিকে সর্বত্র টেন্ডারবাজ, দখলবাজ, চাঁদাবাজদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। মানুষ হাঁপিয়ে উঠেছে। ক্রমাগতভাবে সমস্যা সৃষ্টি হতে হতে সমস্যার পাহাড় তৈরি হয়েছে। অধিকাংশ সাংবাদিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবীসহ প্রায় সব পেশাজীবীশ্রেণি স্বার্থের কারণে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি করে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর পরিচয় ভুলে গিয়ে দলীয় ভূমিকা পালন করছেন। ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত ও স্থায়ীকরণের লক্ষ্যে প্রশাসনযন্ত্রকে ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন।
ন্যায়নীতিভিত্তিক রাষ্ট্রনীতি এবং সৎ যোগ্য নেতৃত্ব যদি দেশে না থাকে তাহলে দেশের যে কত দুরবস্থা হয়, রাজনৈতিক অঙ্গন যে কত ভয়াবহ হয় এবং মানুষের জীবন যে কত দুর্বিষহ হয় এর বাস্তব নিদর্শন হলো বাংলাদেশের বিরাজমান রাজনৈতিক অঙ্গন। যার কারণে স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও দেশ শাসনের সঠিক কোনো পদ্ধতি গড়ে ওঠেনি। পদ্ধতি যা গড়ে উঠেছে তা অত্যন্ত বিভীষিকাময়, হৃদয়বিদারক, ধ্বংসাত্দক, হিংসাত্দক, ভয়ঙ্কর, জংলি ও বর্বর। রাজনীতিবিদরা সন্ত্রাসীদের ভাষায় কথা বলে। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কাজে নিয়োজিত বাহিনী ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা রাজনৈতিক নেতাদের ভাষায় কথা বলে।
স্বাধীনতার ৪৩ বছরে এ দেশে অনেক নেতার, দফার ও সরকার কাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে। গণতন্ত্র উদ্ধার আর গণতন্ত্র রক্ষার নামে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। অনেক হরতাল-অবরোধ হয়েছে। হাজার হাজার মানুষের জীবন ধ্বংস হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়েছে। এত কিছু করার পরেও কি সুস্থ কোনো রাজনৈতিক ধারা এবং সঠিক ও কল্যাণময় দেশ শাসনের কোনো পদ্ধতি গড়ে উঠেছে? আদৌ না; বরং রাজনৈতিক অঙ্গন হয়ে পড়েছে দূষিত, বিষাক্ত, কলুষিত ও নোংরা। রাজনৈতিক কোনো সুস্থ ধারা না থাকার কারণে স্বাধীনতার পর থেকে যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারা যেসব অনৈতিক বিষয়ের বিস্তৃতি ঘটিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মানবাধিকার লঙ্ঘন, অনুৎপাদন, বেকারত্ব, জাতীয় চরিত্র ধ্বংস, সর্বত্র দলীয়করণ, ক্ষমতাসীনদের ভাগ্যের চরম উন্নয়ন, জাতীয় অনৈক্য ও সংঘাত, গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, রাজনীতির নামে ব্যক্তিস্বার্থ, দলীয় স্বার্থ তথা কায়েমি স্বার্থ প্রতিষ্ঠা, বিদেশি শক্তির তাঁবেদারি ও মনোরঞ্জনের প্রতিযোগিতা।
অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলগুলো সবসময় দ্বৈত ভূমিকা পালন করে আসছে। ক্ষমতায় থাকলে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বুঝেন না আবার ক্ষমতাহীন হয়ে যখন বিরোধী দলে থাকেন, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবেন না বলে আন্দোলনের নামে দেশে চরম নৈরাজ্য, ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলেন।
১৯৯৬ সালের আন্দোলনের একপর্যায়ে খালেদা জিয়াকে টার্গেট করে আওয়ামী লীগ-জামায়াত-জাতীয় পার্টি ঘোষণা দিয়েছিল, নির্বাচনী সফরে যে জেলাতেই খালেদা সফর করবেন সেই জেলাতেই হরতাল হবে। তাই হয়েছিল।
কিন্তু ১৫ বছর পর শেখ হাসিনা তার অবস্থান পুরোপুরি পাল্টে ফেলেছেন। একই অবস্থা খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। তিনি বলেছিলেন, শিশু আর পাগল ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানবিরোধী।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ একতরফাভাবে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের মাধ্যমে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা বাতিলের ফলে দেশে নতুনভাবে রাজনৈতিক সংকটের সূচনা হয়েছে।
যার পরিণতিতে গত বছরের ৫ জানুয়ারি দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বর্জন করেছে। যে নির্বাচনে ১৫৪ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। যে নির্বাচন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল নিয়ম রক্ষার একটি নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অতি দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির জন্য আলোচনা শুরু করবে। কিন্তু আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম, ক্ষমতাসীনরা সংলাপ এবং সমঝোতার পথে না গিয়ে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে দমন করতে গিয়ে পরিস্থিতিকে আরও জটিলতর করে তুলেছে।
আজীবন ক্ষমতায় থাকা এবং যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়ার মদমত্ততায় পাগলপারা দলগুলোর ধ্বংসাত্দক এবং প্রাণঘাতী কার্যকলাপে দেশ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সংকট বার বার প্রকট আকার ধারণ করেছে। এর থেকে উত্তরণে কিছু প্রস্তাবনা আমি সচেতন, দেশপ্রেমিক, ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে পেশ করছি-
দলীয় সরকারের চেয়ে নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন তুলনামূলকভাবে সুষ্ঠু ও অবাধ হয়। এ লক্ষ্যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন সময়ের একান্ত দাবি। সংবিধানের দোহাই দিয়ে সুষ্ঠু, অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন কোনোক্রমেই বাধাগ্রস্ত করা যাবে না।
প্রচলিত রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে রাজনীতিকে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত রাখতে হবে। কোনোক্রমেই দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিক দলে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। কারণ, দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসীদের কোনো রাজনীতি করার অধিকার থাকতে পারে না।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, জাতীয় সংহতি ও কার্যকর জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠাকল্পে সংসদ নির্বাচনে বিকল্প পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে। জনগণ ভোট দেবে দলকে, কোনো ব্যক্তিকে নয় এবং ভোটের আনুপাতিক হারে দলগুলো আসন বরাদ্দ পাবে। যার ফলে কালো টাকা, পেশিশক্তি, ভোট কারচুপি বন্ধ হবে। দলের আদর্শ ও নেতা-কর্মীদের সততা ও যোগ্যতা বিবেচনা করে জনগণ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবে।
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় শুধু আইনের শাসন নয়, ন্যায়ের শাসনও প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
রাষ্ট্রের সব স্তর থেকে দুর্নীতি সন্ত্রাস শুধু দমন নয়, নির্মূল করতে হবে। সার্বিক কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনব্যবস্থা ইসলাম এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশ দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও দারিদ্র্যমুক্ত সুখী-সমৃদ্ধ কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে।
জাতীয় সংসদসহ সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সৎ, যোগ্য ও আল্লাহভীরু প্রার্থীদের নির্বাচিত করতে হবে। যারা আল্লাহ, জনগণ এবং নিজের বিবেকের সঙ্গে জবাবদিহিতায় দায়বদ্ধ থাকবে।
রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাজনৈতিক সংঘাত, হানাহানি নিরসন ও প্রতিহিংসার রাজনীতি পরিহার করে সহনশীল মনোভাব সৃষ্টি করে আন্তঃদলীয় সংলাপ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে।
আমরা মনে করি, চলমান জাতীয় সংকট উত্তরণে ক্ষমতাসীন সরকারকেই দায়িত্ব নিয়ে গ্রহণযোগ্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শক্তি প্রয়োগে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন এবং বাকস্বাধীনতা হরণের পরিণাম কারও জন্যই ভালো হবে না।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় দেশের একজন মানুষেরও জীবনহানি ঘটুক ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ তা চায় না। তাই আমরা এ মুহূর্তেই রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। আজ থেকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সংকট নিরসনে দেশের রাজনৈতিক দল, ওলামায়ে কেরাম, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, সুশীল সমাজ এবং বিভিন্ন শ্রেণিপেশার প্রতিনিধিত্বশীল মানুষের সঙ্গে সংলাপ শুরু করবে। ক্ষমতাসীন সরকার যদি আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অতি দ্রুত শান্তিপূর্ণ সমাধানে পেঁৗছতে না পারে তা হলে আমরা দেশ রক্ষায় এবং দেশের মানুষের জীবন-সম্পদ রক্ষায় দেশের শান্তিকামী জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ২৬ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দেশব্যাপী নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করব, ইনশাআল্লাহ।
লেখক : পীর সাহেব চরমোনাই