ম্যাডামের অফিসে এখন এমন একজন রাজনৈতিক নেতৃত্বসম্পন্ন সহকারী (কিন্তু কর্মচারী নয়) দরকার যিনি রাজনীতি বোঝেন। ম্যাডাম কার্যত গুলশান অফিসে বন্দী। বাইরের সবকিছু থেকে সরকার ম্যাডামকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। সারা দেশের বর্তমান অবস্থা বিশেষ করে আন্দোলনের হাল-হকিকত ম্যাডাম জানতে পারেন না। মাঠ পর্যায়ে জেলা-উপজেলার নেতা-কর্মীদের ম্যাডামের নামে প্রতিনিয়ত বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। তাদের বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত করানো হচ্ছে। ম্যাডামকে প্রতিদিন জানানো হচ্ছে, 'সারা দেশে দুর্বার গতিতে আন্দোলন চলছে। সব বারে বিএনপির প্যানেল বিপুল ভোটে জয়ী হচ্ছে। সরকার খুব তাড়াতাড়ি পড়ে যাবে। সরকারের কিছু দালাল এবং চর ছাড়া দলের সবাই ঐক্যবদ্ধ' ইত্যাদি। ম্যাডামের আশপাশে কয়েকজন নির্দিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারোর কাছ থেকে কোনো কিছু জানার উপায়ও ম্যাডামের নেই। ম্যাডাম এখন সম্পূর্ণ একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ। বর্তমান আন্দোলনে ম্যাডামের সঙ্গে যে কজন করিৎকর্মা মহারথী গুলশান অফিসে দিনরাত ঘুমিয়ে কাটাচ্ছেন তারাই আন্দোলনকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের (!) দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। দুর্ভাগ্য হচ্ছে ম্যাডাম ওদের ছাড়া অন্য কাউকে বিশ্বাসও করেন না। অথচ ম্যাডাম বুঝতে চাচ্ছেন না তারা তাকে এবং দলকে ডুবাচ্ছেন। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরাও অভিমান করে ম্যাডামের সঙ্গে এ বিষয়গুলো নিয়ে সরাসরি কথা বলেন না। অনেকে আবার নিজেদের অতীত কার্যকলাপের জন্য ম্যাডামের কাছে লজ্জিত, যার পূর্ণ সুযোগ নিচ্ছে একটি কায়েমি স্বার্থান্বেষী চক্র। ম্যাডামের স্বাস্থ্য ও শরীরের অবস্থা নিয়ে সারা জাতি উদ্বিগ্ন। সারা জাতি ম্যাডামের স্বাস্থ্যের প্রতিদিনের বুলেটিন আশা করে। সরকার কোনো অবস্থায় সে বুলেটিন প্রকাশ হতে দেবে না কিন্তু ম্যাডামের গুলশান অফিসে যারা আছেন সরকারের বিরাগভাজন হয়েও প্রতিদিন সেই বুলেটিন প্রকাশের চেষ্টা তাদের করা উচিত, কারণ এর মধ্যে অবশ্যই বিশাল রাজনীতি আছে। এ বুলেটিন সরকারের ওপর চাপও সৃষ্টি করবে এবং ম্যাডামের জীবনের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করবে। না হলে সরকারের কাছ থেকে একদিন জাতি হয়তো শুনবে ম্যাডাম গুলশান অফিসে নেই এবং কবে থেকে নেই তাও কেউ বলতে পারছে না!!
ম্যাডামের নেতৃত্বে দেশে নজিরবিহীন লাগাতার গণআন্দোলন চলছে। এ আন্দোলন সফল না বিফল তা মূল্যায়নের সময় এখনো আসেনি। তবে এ আন্দোলন যে লাগাতার চলবে তা ম্যাডামের সাম্প্রতিক বক্তব্যে জনগণ ভালোভাবে বুঝে নিয়েছে। চলমান আন্দোলন সরকার বা তার দোসরদের মনঃপূত না হলেও তা যে বিএনপিমনা জনগণের পূর্ণ সমর্থন পেয়েছে তাতে কারও বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আন্দোলন ধীরে ধীরে গতি পাচ্ছে এবং আন্দোলন তার লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হছে। ম্যাডামের পরিকল্পনা মোতাবেক আন্দোলন তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাবেই পৌঁছাবে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই এবং থাকতে পারে না।
ম্যাডামের এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আন্দোলনের গতি-প্রকৃতির সর্বশেষ তথ্যাদি সঠিক সময়ে পাওয়া। কিন্তু সরকার তা কোনো অবস্থায়ই দিতে চাইবে না এবং সরকার সর্বশক্তি নিয়োগ করে ম্যাডামের কাছে তথ্য আদান-প্রদানের সব পথ বন্ধ করে রাখবে। এটাই স্বাভাবিক। সরকার খুবই দক্ষতার সঙ্গে ম্যাডামকে প্রচলিত অর্থে গ্রেফতার না করেও গণবিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। গণবিচ্ছিন্ন এ অর্থে যে, সবার পক্ষে ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হছে না। অথচ ম্যাডাম গ্রেফতার হয়ে বন্দী বা তাকে নিজ অফিসে অবরুদ্ধ করে রাখার কথা অত্যন্ত সচতুরতার সঙ্গে সরকার অস্বীকার করে যাচ্ছে। সরকারের এহেন চাতুর্যপূর্ণ চাণক্যবাজি সম্ভব হচ্ছে সরকারের সঙ্গে আমাদের অনেকের সহযোগিতার কারণে।
ম্যাডামের কাছে এখন যত বেশি নেতা, কর্মী, অনুসারী বা বিভিন্ন জনসাধারণ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যাবে আন্দোলন তত বেশি বেগবান হবে। ম্যাডামের সঙ্গে খোলামেলা দেখা-সাক্ষাৎ হলে সরকারই বেকায়দায় পড়বে। ম্যাডামের সঙ্গে বিভিন্ন পেশা-শ্রেণির লোক নিয়মিত যাতায়াত করতে পারলে তখন ম্যাডাম কার মাধ্যমে দলের কাছে বার্তা পাঠাচ্ছেন তা সরকারের পক্ষে বোঝা কষ্টকর হবে। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী এবং দলের শুভাকাঙ্ক্ষীরা যদি ম্যাডামের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে, সুযোগে বা বাহানায় দেখা করতে যেত তাহলে আন্দোলনের দুটি লাভ হতো। প্রথমত, এর ফলে আন্দোলনের সঠিক খবর তিনি পেতেন এবং তিনিও প্রকৃত লোকের কাছে তার নির্দেশ বা অনুরোধ বা করণীয় যথাযথভাবে জানিয়ে দিতে পারতেন। দ্বিতীয়ত, যদি সরকার কাউকে দেখা করতে না দিত তাহলে ম্যাডাম যে বন্দী বা অবরুদ্ধ তা জলবৎ তরঙ্গের মতো জনগণের সামনে পরিষ্কার হয়ে যেত। তা ছাড়া যদি কাউকে কাউকে ঢুকতে দিত বা না দিত তাহলে আমাদের চরিত্রও জনগণের সামনে পরিষ্কার হয়ে যেত। এ ছাড়াও দলের সন্দেহভাজন যাদের সরকারের দালাল বা চর বলা হয় তারা তখন ঝুঁকি নিয়ে ম্যাডামের সামনে যেতে চাইত না। কারণ ম্যাডামের সামনে গেলে ম্যাডাম হয়তো ওই সরকারের দালাল বা চরদের আন্দোলনের কঠিন কোনো দায়িত্ব দিয়ে দিতেন যা পালন করতে গিয়ে চর বা দালালরা বেকায়দায় পড়ে যেত। আমার ক্ষুদ্রমতে যত বেশি মানুষ ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করতে পারত আন্দোলনে জনগণের সম্পৃক্ততা জ্যামিতিক হারে তত বেশি বেড়ে যেত। সবাই তখন ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করে আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার চেষ্টা করত। এটা চরম বাস্তবতা। মানুষের চরিত্রের সহজাত ধর্ম। নেত্রীর সামনে সবাই সরল এবং দায়বদ্ধ (committed) হয়ে যায়। বস্তুবাদী পৃথিবীতে মানুষ অনেক বেশি বাস্তববাদী। নেত্রীর সরাসরি নির্দেশে দলের যে কোনো পর্যায়ের একজন নেতা-কর্মী যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে তা দলের অন্য নেতাদের কথায় কতটুকু পড়বে তা বুঝতে নিশ্চয় কোনো সচেতন মানুষের বেগ পাওয়ার কথা নয়।
আগে মোসাদ্দেক আলী ফালু সাহেবকে দেখেছি দলের বিভিন্ন ক্রাইসিসের সময় তিনি নিজে থেকেই বিভিন্ন নেতা-কর্মীকে ডেকে ম্যাডামের সামনে নিয়ে আসতেন এবং ম্যাডাম দায়িত্ব বণ্টন করে দিতেন। এতে দলের নেতা-কর্মীরা যেমন দায়িত্ব পালনে উৎসাহিত হতো তেমনি ম্যাডাম সরাসরি নেতা-কর্মীদের যথাযথ মূল্যায়নের সুযোগ পেতেন। এখন সমস্যা দাঁড়িয়েছে বহুমুখী। সব নেতা-কর্মী এমনকি স্থায়ী কমিটির সম্মানিত সদস্যরা সরাসরি ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করতে পারেন না। ফলে তার চারপাশ যারা ঘিরে আছে তারা সব ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব নেতা-কর্মীদের ঘাড়ে চাপিয়ে সফলতার কৃতিত্ব ১০০ ভাগ নিয়ে নিতে চায়। কিন্তু চরম বাস্তবতা হলো সফলতার সঙ্গে কোনো কাজ করার যোগ্যতা, দক্ষতা, কর্মক্ষমতা কোনোটাই ম্যাডামের চারপাশ ঘিরে থাকা চাটুকারদের নেই এবং থাকলে চাটুকার হতে হয় না।
দলের সবাই তো দুর্নীতিবাজ বা সরকারের দালাল নয়। সরকার তো সবাইকেই গ্রেফতারের ক্ষমতাও রাখে না। যদি রাখে তাহলে সরকার চরম ফ্যাসিবাদী এবং নির্মম স্বৈরাচারী হয়ে যাবে এবং রাজনীতিও তখন অন্য রকম হবে। এ সরকার ফ্যাসিবাদী সন্দেহ নেই, তবে চরম ফ্যাসিবাদী নয়। বর্তমান সরকারপ্রধান একনায়ক এতেও কোনো সন্দেহ নেই, তবে স্বৈরশাসক নন। সরকারের বাহ্যিক চরিত্র গণতান্ত্রিক এবং বহুমাত্রিক। ইচ্ছা করলেই সরকার চরম ফ্যাসিবাদী বা নির্মম স্বৈরশাসক হতে পারবে না। সে পথে গেলে সরকার তার নিজের অস্তিত্বকেই চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেবে। আইনের শাসন এবং গণতন্ত্রের লেবাস সরকারের রক্ষাকবচ। এর বাইরে সরকার তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে না। কাজেই সরকারকে এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যারা সরকারকে ভয় পায় তারা তাদের ব্যক্তিগত সমস্যার জন্য পায়। যারা আকাম-কুকাম করবে, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি করবে তারা সরকারকে ভয় পাবে না তা কখনো হয় না। তবে জনগণের জন্য, জনকল্যাণের জন্য যারা রাজনীতি করে তাদের জন্য জেলখানা এবং গণভবন পাশাপাশি থাকে, যার যে কোনো একটাতেই তাদের অবস্থান থাকে। প্রকৃত জনকল্যাণকামী সরকারের জেল-জুলুম-নির্যাতনকে কখনোই ভয় করে না। তারা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেই রাজনীতি করে। রাজনীতি করলে জেলে যেতেই হবে বা মামলায় জড়াতেই হবে। তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতির এটাই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সাম্প্রতিক দুর্নীতির মামলা এ বৈশিষ্ট্যকে আরও সুদৃঢ় করেছে।
চলমান আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সরকার ম্যাডামের সঙ্গে কাউকে দেখা করতে দেবে না এবং দেবে না সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থে এবং অস্তিত্বের প্রশ্নে। আন্দোলনের সফলতার কারণ হবে এমন কোনো কাজ বিএনপি বা ম্যাডামকে করতে দেওয়ার মতো বোকা কোনো কর্মকর্তা পুলিশ বা সরকারের কোনো এজেন্সিতেও নেই। কাজেই এখন সুযোগ বুঝে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে। যখনই কোনো সুযোগ পাওয়া যাবে তখনই তার সদ্ব্যবহার করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে সুযোগ সব সময় আসবে না। রাজনীতি বুদ্ধির খেলা। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রাজনীতি হয় না। সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে ম্যাডামের অফিসটি সম্পূর্ণ সরকারের নিয়ন্ত্রণে এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে ওখানে কেউ নেই। তাই সেখানে কাজ করতে হবে খুবই দক্ষতা, বিচক্ষণতা এবং চতুরতার সঙ্গে চাণক্য বুদ্ধি নিয়ে।
চলমান আন্দোলনের স্বার্থে এবং আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে প্রতিদিনই ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করার জন্য সবার গুলশান অফিসে ভিড় করা উচিত। তাতে সরকার যদি বাধা দেয় বা গ্রেফতার করে তাহলে সরকারেরই ক্ষতি হবে এবং সরকার অবশ্যই বেকায়দায় পড়ে যাবে। সরকার গুলশান অফিসে ঢুকতে দেওয়ার পরে কেউ যদি ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করতে না দেয় তাহলে তাকে যেমন চিহ্নিত করে রাখতে হবে এবং একইভাবে যারা যারা ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করার জন্য ভিতরে যাবে তাদেরও ভিতরে যাওয়ার পরে দায়িত্ব দিয়ে তাদের সম্পর্কে ধারণা নিয়ে রাখতে হবে। ম্যাডাম তথা বিএনপি তথা ২০-দলীয় ঐক্য জোট যে লড়াইয়ে নেমেছে সে লড়াই থেকে পিছু হটার কোনো সুযোগ নেই। এ লড়াই অস্তিত্বের লড়াই। এ লড়াইয়ে জিততেই হবে। যা কিছু হারানোর সবকিছুই তো আমরা হারিয়েছি, নতুন করে আর আমাদের হারানোর কিছুই নেই। তবে আছে জয়ের বিশাল প্রত্যাশা। ভয়কে উপেক্ষা করে যে দাঁড়াতে পারবে জয়ের মালা তো তার গলায় জনগণই পরিয়ে দেবে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।