স্বীকার করতেই হবে যে, আমাদের দেশের বিভিন্ন সময় অর্জিত তাবৎ সাফল্য এবং মহৎ সব অর্জনের পেছনে প্রধান ভূমিকা ছিল রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের। ধারণা করাটা ভুল বা অসমীচীন নয় যে, একটি রাজনৈতিক দলের নির্দিষ্ট নীতি থাকবে, থাকবে একটা আদর্শ। নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে প্রণীত হবে রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণধর্মী কিছু কর্মসূচি। এই নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচির ভিত্তিতেই একটি রাজনৈতিক দল জনগণের মধ্যে তার অবস্থান সুদৃঢ় করে এবং যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন আদায় করতে পারে সেই দল রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায়। রাষ্ট্রক্ষমতা দেশ ও জনগণের সেবার জন্য বেশ কাজে লাগে, যদি ক্ষমতাসীনরা তার ব্যবহারে সৎ ও আন্তরিক হয়। তবে রাষ্ট্রক্ষমতায় না গিয়েও দেশ ও জনগণের সেবা করা যায়। আমাদের দেশে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, কমরেড মণি সিংহসহ অনেক ত্যাগী রাজনৈতিক নেতার নাম উল্লেখ করা যাবে, যারা ক্ষমতায় না গিয়েও দেশ ও জাতির যে সেবা করে গেছেন অনেক ক্ষমতাসীন তা করেননি বা করতে পারেননি।
আমাদের এই ভূখণ্ডে একটা সময় ছিল রাজনীতির সোনালিকাল। রাজনীতিবিদরা ছিলেন দেশকর্মী। দেশকর্মীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল দেশের জন্য কে বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে পারে। এই সময়কালটা ধরা যেতে পারে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকাল থেকে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকাল পর্যন্ত। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের লক্ষ্যই ছিল স্বদেশ ভূমিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দখলমুক্ত করা। সেই আন্দোলনে দুটি ধারা ছিল- ১. প্রকাশ্য নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন, ২. সশস্ত্র গোপন লড়াই। পথ ভিন্ন হলেও মত ছিল অভিন্ন- ব্রিটিশ খেদাও। সেই আন্দোলনে মূল রণধ্বনিই ছিল স্বাধীনতা- এর বেশিও না, তিল পরিমাণ কমও না। কে প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী হবেন, কারা মন্ত্রিসভায় থাকবেন এসব স্বার্থবাদী চিন্তা কাউকে দিকভ্রান্ত করেনি, দেশমুক্তির চিন্তায় সবাই ছিলেন বিভোর। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধেও রণধ্বনি ছিল একটাই- 'দেশ চায় স্বাধীনতা, জাতি চায় মুক্তি'। জনগণের আকাঙ্ক্ষায় এছাড়া অন্য কোনো স্বার্থচিন্তা ছিল না। স্বার্থচিন্তা ছিল না বলেই মুষ্টিমেয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস ছাড়া সমগ্র দেশবাসী স্বাধীনতার প্রশ্নে ছিল একাট্টা। বিভ্রান্তি আর বিপদগামিতার সূত্রপাত হয় দেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়ে আসার পর। জাতীয় একটি কুচক্রী মহলের সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক লোভ-লালসার নানা খেলা শুরু হয়, চক্রান্ত হয় স্বাধীন বাংলাদেশকে নতজানু একটা দেশে পরিণত করার।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা এদেশের জনগণের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা ও যূথবদ্ধ লড়াইয়ের সোনালি ফসল। কারও উপহার বা দয়ার দান নয়। ব্রিটিশ-ভারতের ১০ কোটি মুসলমানের জন্য স্বাধীন আবাসভূমি 'পাকিস্তান' হাসিলের লড়াইয়ের প্রকৃতি ছিল একরকম। 'অনুশীলন' 'যুগান্তর'সহ কিছু বিপ্লবী সংগঠনের বুক কাঁপানো সীমিত কিছু বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের বাইরে ব্যাপকভিত্তিক কর্মকাণ্ড ছিল গণসংশ্লিষ্ট প্রকাশ্য রাজনৈতিক তৎপরতা। সর্বভারতীয় মুসলমানদের বিপুল সমর্থিত সংগঠন ছিল 'অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ'। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগ অধিবেশনে শেষ দিনে অবিভক্ত ভারতবর্ষের ১০ কোটি মুসলমানের স্বকীয় জীবনধারা স্বাধীনভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্র বাসভূমি কায়েমের দাবিতে অবিভক্ত বঙ্গের প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক পেশ করেন ঐতিহাসিক 'লাহোর প্রস্তাব'। প্রস্তাবের চুম্বক কথা ছিল, 'এ দেশে কোনো শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনই কার্যকর কিংবা মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না, যদি না অতঃপর বর্ণিত মূল নীতিসমূহের ভিত্তিতে তাহা পরিকল্পিত হয়। যথা, ভৌগোলিক নৈকট্য সমন্বিত ইউনিটগুলো প্রয়োজন অনুসারে স্থানিক রদবদলপূর্বক সীমানা চিহ্নিত করিয়া অঞ্চল গঠন করিতে হইবে এবং মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল যেমন, ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল সমন্বয়ে অবশ্যই স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠন করিতে হইবে, যেখানে অন্তর্ভুক্ত ইউনিটগুলো স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম হইবে' (জাতীয় রাজনীতি : ১৯৪৫-৭৫, লেখক-অলি আহাদ, পৃষ্ঠা-৩)। এই লাহোর প্রস্তাবকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার একটা ভিত্তি বলে বিবেচনা করা হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় বাঙালি মুসলমানদের ভূমিকা ও অবদান ইতিহাসের অন্তর্গত বিষয়। ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ১১৯টি মুসলিম আসনের মধ্যে ১১৩টিতে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে মুসলিম লীগ এবং ২২ এপ্রিল '৪৬ বঙ্গীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। যে পরিকল্পনা ও কর্মকৌশল নিয়ে পাকিস্তান আন্দোলন সফল হয় এবং রাষ্ট্রটি ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত হয়, নতুন স্বপ্নের দেশ পাকিস্তানে তা মোটেও কার্যকর ও ফলপ্রসূ হয়নি। যাদের সমর্থনে ও আন্দোলনে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লড়াই পূর্ণতা পায়, পাকিস্তানের সেই পূর্বাঞ্চলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয় রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই। এই অঞ্চলকে (পূর্ব পাকিস্তান) শোষণ-বঞ্চনার স্বর্গভূমিতে পরিণত করার গভীর চক্রান্তের অংশ হিসেবে প্রথমে আক্রমণ করা হয় বাংলাভাষার ওপর। বাংলা 'পূর্ব পাকিস্তানের' জনগণের মাতৃভাষা বিধায় বাংলা ভাষার টুঁটি চেপে আসলে আমাদের ভাষাকে নয়, ওরা হত্যা করতে চেয়েছিল আমাদের সংস্কৃতিকে। ভাষা ও সংস্কৃতির মৃত্যু হলে একটি জাতির স্বাতন্ত্র্য এবং জাতীয় আত্দবিকাশের পথই অবরুদ্ধ হয়ে যায়। এই সুগভীর চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল ছাত্র-যুব-জনতা। সবার সামনে ছিল আদর্শ। তখনকার রণধ্বনি ছিল 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই'। এই স্লোগানের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল বাঙালির স্বজাত্যবোধ প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞা, চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতার স্বপ্ন। যুব-তরুণদের চোখে তখন আগুন, বুকে উত্তাল সাগরের গর্জন। নিজেদের মধ্যে হিংসা নেই, পারস্পরিক বিদ্বেষ নেই। নেই গদির লোভ বা বিত্ত হাতানোর নষ্ট চিন্তা। ভাষার আন্দোলন সফল হয়েছে। চুয়ান্ন সালের নির্বাচনে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে গদি নিয়ে কামড়াকামড়ি হয়নি, অবশ্য রাজনৈতিক বিরোধ হয়েছে। 'পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি,' 'সিয়েটো-সেন্টো চুক্তি', 'বাগদাদ প্যাক্ট' ইত্যাদি সাম্রাজ্যবাদ-ঘনিষ্ঠ চুক্তি নিয়ে পাকিস্তানের তৎকালীন আওয়ামী প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে বিরোধ বাধে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা ও দলের তৎকালীন সভাপতি মওলানা ভাসানীর। আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে ১৯৫৭ সালের ২৫ জুলাই তিনি গঠন করেন 'ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি' (ন্যাপ)। বিরোধটা গদির নয়, রাজনীতির। এর ভিতর আগে-পরে ঘটে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। ৯৮(ক) ধারা জারি করে রাজনীতিবিদদের গ্রেফতার, যুক্তফ্রন্ট সরকার বাতিল এবং '৫৮ সালে আইউব খানের মার্শাল ল' জারি। আবার নতুন সংগ্রাম, নতুন লড়াই। এ লড়াই আরও স্পষ্ট, আরও অগ্রসর। এবার রণধ্বনি 'গণতন্ত্র চাই, নির্বাচন চাই, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন চাই।' এখানেও রাজনীতি আগে, দেশ আগে। সব কিছু স্পষ্টতর হতে থাকে। '৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেন ৬ দফা কর্মসূচি, মওলানা ভাসানীর ১৪ দফা। দুজনের লক্ষ্যই এক- বাঙালি জাতীয়তাবাদী জাগরণ সৃষ্টি করা। মওলানা ভাসানীর সঙ্গে চীনপন্থি বলে পরিচিত বাম- কমিউনিস্টরাসহ সারা দেশেই বেশ কিছু সৎ, ত্যাগী ও আদর্শবাদী রাজনীতিবিদ ছিলেন, কিন্তু তার তেমন কোনো শক্তিশালী সংগঠন ছিল না যা দেশব্যাপী একটা জাগরণ সৃষ্টি করতে পারে। অপরদিকে মওলানা ভাসানীর অনুসারীদের মতো সৎ, আদর্শবাদী নেতা-কর্মীর অভাব থাকলেও সারা দেশে বঙ্গবন্ধুর তুলনামূলক জোরালো সংগঠন ছিল। বঙ্গবন্ধু সফল হলেন। পরিণত হলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতায়। এ ক্ষেত্রেও বিরোধ হলো না ভাসানী-মুজিবের। সত্তরের নির্বাচন নিয়ে এবার কথা বলি। মওলানা ভাসানী সেই নির্বাচন বর্জন করলেন 'ভোটের আগে ভাত চাই', স্লোগান দিয়ে। মওলানা সাহেবের নির্বাচন বর্জন নিয়ে নানাজন নানা কথা বলার চেষ্টা করেন। কেউ কেউ মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক 'ভুল ধরার'ও দৃষ্টতা দেখান এ ব্যাপারে। অথচ ঘটনা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, মওলানা ভাসানীর সেই ভোট বর্জন ছিল ভাসানী-মুজিব সমঝোতার বাস্তবায়ন। হিসাবটা একেবারেই সহজ। ওই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনেই জিতেছিল। মওলানা ভাসানীর ন্যাপ যদি নির্বাচনে অংশ নিত, তাহলে কি হতো? বিশ্লেষকরা যা তখন বলেছিলেন, তার নির্যাস হচ্ছে ৬৮ থেকে ৭২টি আসনে ন্যাপের ভালো প্রার্থী ছিল। আসন বেশি না পেলেও তারা ভোট কেটে নিত বাঙালির, নৌকার এবং তাতে কমপক্ষে ৪৫ থেকে ৫৩টি আসনে হেরে যেত আওয়ামী লীগ। তখন পাকিস্তান জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেত না। তাহলে কি হতো? কল্পনাই করা যায় না। সম্পূর্ণ বিষয়টাই রাজনৈতিক, দেশকেন্দ্রিক। সারা দুনিয়া দেখল বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের বিজয়কে দেখা হয় বাঙালিদের বিজয় হিসেবে। ৬ দফা আন্দোলন এবং ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলন জাতিকে লক্ষ্যপানে এগিয়ে দেয় অনেক দূর।
এরপর চলে আসি একাত্তরে। সংকট তখন তীব্র। পাকিস্তান রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে সমগ্র বাঙালি জাতির দ্বন্দ্ব ততক্ষণে পৌঁছে গেছে মীমাংসার অযোগ্য স্তরে। সমাধান নিহিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রযন্ত্র ভেঙে দেওয়ার মধ্যে। অর্থাৎ যুদ্ধ অনিবার্য। পাকিস্তানের সঙ্গে বাঙালিদের যুদ্ধ। এ নিয়ে প্রথমে দ্বন্দ্ব ছিল কারও কারও মধ্যে। যুদ্ধ না শান্তি? পাকিস্তান না কি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ? বাংলাদেশের পক্ষেই কিছু দালাল বাদ দিয়ে সাড়ে সাত কোটি 'বাঘ' গর্জে উঠল।
২৫ মার্চের কালরাতে বাংলাদেশের ঘুমন্ত, নিরস্ত্র, অপ্রস্তুত ও অসংগঠিত মানুষের ওপর কাপুরুষের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। শুরু হয় যুদ্ধ, ঘোষিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। পরিপূর্ণ বিজয় আসে ১৬ ডিসেম্বর '৭১। ৩০ লাখ শহীদের তাজা খুন, দুই লক্ষাধিক মা-বোনের লুণ্ঠিত সম্ভ্রম, লাখ লাখ মানুষের সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে লাল-সবুজের পতাকা উড়ছে আমাদের আকাশে। এই স্বাধীনতা আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন। যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই স্বাধীনতা আমাদের গৌরবের, অহংকারের। সৎ ও আদর্শবাদী রাজনীতির আলোকিত প্রভাতের ইশারায় দিন শেষে আমরা আজ স্বতন্ত্র পতাকা হাতে হাঁটছি পায়ে পায়ে। কিন্তু আমাদের মহান স্বাধীনতার গৌরবকে ম্লান করে দিচ্ছে অসুস্থ রাজনীতি।
স্বাধীনতার পর আমাদের সব কিছু আগের তুলনায় আরও অগ্রসর হবে এই প্রত্যাশা মোটেও বেশি নয়। কিন্তু জাতির সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। পাকিস্তান আমল থেকে রাজনীতিতে যে নীতি ও আদর্শের ধারার কথা ওপরে উল্লেখ করেছি, এখন সেই ধারা পথ হারিয়েছে। নীতিবাদ, আদর্শবাদ এখন রাজনীতি থেকে বাদ পড়েছে। রাজনীতি আমাদের দেশে এখন শুধুই ক্ষমতার খেলা। আর এই ক্ষমতা ব্যক্তিবিশেষ, পরিবারবিশেষ এবং গোষ্ঠীবিশেষের জন্য। রাজনীতি এখন টাকা বানানোর মেশিন যেন! বিনা পুঁজি বা অল্প পুঁজিতে কম সময়ে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার নির্ভরযোগ্য অবলম্বন। দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলে, বিশেষ করে বিএনপি ও আওয়ামী লীগে সৎ, আদর্শবাদী, ত্যাগী নেতা-কর্মীদের যথার্থ মূল্যায়ন নেই, শুধু তাই নয়, দলের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এদের কোনো অবস্থানও নেই। এই সব দল এখন ব্যবসায়ী, কালো টাকার মালিক, অবসরপ্রাপ্ত আমলা এবং মাসলপাওয়ারে ঠাসা। রাজনীতিবিদরা আছেন ট্রেনের কম্পার্টমেন্টের ভিতরে জায়গা না থাকায় দরজায় ডাণ্ডা ধরে ঝুলে থাকার মতো। যারা ক্ষমতায় যেতে পারে তারা আর ক্ষমতা হারাতে চায় না, বিরোধী দলে চলে গেলে গদির নেশায় অস্থির হয়ে যায়। কোনো দলে গণতন্ত্রের চর্চা ও অনুশীলন নেই। দুই দলের দুই নেত্রীর কাছে দলীয় প্রধানের পদ দুটি যেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তই দেওয়া আছে। তারা দুজন দলীয় প্রধানের পদ দুটি দখল করেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। তারপর দলের অন্যান্য নেতার পদও বেরিয়ে আসে তাদের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে। এই অগণতান্ত্রিক চর্চা চলে উঁচু থেকে নিচু সব স্তরে। দলে রাজনীতি না থাকলে, গণতন্ত্র না থাকলে থাকে কী? দল হয়ে পড়ে পেশিনির্ভর। এরাই দলে চালু করেছে লুটেরা সংস্কৃতি। রাজনৈতিক দলে পেশিনির্ভর অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের সমাহারই সন্ত্রাস-সহিংসতা ও নৈরাজ্যকে উসকে দিচ্ছে। মেধাবী তরুণরা রাজনীতিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। জাতির আগামী দিনের যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে উঠতে পারছে না। ফলে অসাধু, অযোগ্য ব্যবসায়ী ও কালো টাকার মালিকরা দল দখলের সুযোগ পেয়ে ভুল পথে পরিচালনা করছে দলকে। এরাই শাসন করছে রাজনীতি। এতে রাজনীতি অসুস্থ হবে না তো কি? এই অসুস্থ রাজনীতি আমাদের সব জাতীয় সম্ভাবনাকে বিনাশ করে দিচ্ছে। এ দেশের মানুষ সুন্দর জীবনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে বিদেশে পাড়ি জমায়। সমুদ্রপথে পালিয়ে যেতে জীবনের ঝুঁকি নেয়। দেশে কষ্টে বেঁচে থাকার চেয়ে অবৈধ পথে দেশ ছাড়ার মৃত্যুঝুঁকিকেও শ্রেয় মনে করছে কেউ কেউ। অথচ সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব পেলে এদেশ অনেক আগেই সমান্তরাল থাকত সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশের সঙ্গে। একজন লি কুয়ান আর একজন মাহাথির গড়ে দিয়েছেন দুটি দেশ সিঙ্গাপুর আর মালয়েশিয়া। ইদানীং শেখ হাসিনার 'দলদাস' বুদ্ধিজীবীরা বলতে শুরু করেছেন, শেখ হাসিনা নাকি লি কুয়ান আর মাহাথিরের পথ ধরেছেন। এই দুই নেতাই গণতন্ত্রের আগে উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং বিরোধী মত গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তারা ভুলে যান, তাদের শাসনকালে বিশ্বরাজনীতির চরিত্র ও প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। গণতান্ত্রিক শক্তির দুর্বলতায় এবং বিশ্ব মোড়লদের স্বার্থে বিভিন্ন দেশে সামরিক শাসন, একনায়কতান্ত্রিক শাসন দাপটের সঙ্গে বিরাজমান ছিল। কিন্তু দুনিয়াজুড়ে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও শক্তি জোরদার হওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। লি কুয়ান, মাহাথির মোহাম্মদদের চিন্তাচেতনায়ও পরিবর্তন আসে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া কি এখন গণতন্ত্রের কফিনে পেরেক ঠুকে আবার নিষ্ঠুর একনায়কতান্ত্রিক শাসনে ফিরে যেতে পারবে? আমাদের বর্তমান কালটা লি আর মাহাথিরের প্রথম শাসনকাল নয়। এটা বিশ্বময় গণতন্ত্রের পূর্ণ যৌবনকাল। এখন ভিন্ন মত, ভিন্ন দল দমন-দলন করে উন্নয়নের স্লোগান দিয়ে গদি অাঁকড়ে থাকা আর সম্ভব নয়। গণতন্ত্রহীন উন্নয়ন মডেলে জনগণের কোনো লাভও হয় না। লাভ হয় 'রেন্টাল, কুইক রেন্টাল' বিদ্যুৎ প্লান্টের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া সরকারঘনিষ্ঠ অসাধুজনদের। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, লি কুয়ান বা মাহাথির মোহাম্মদের বিরুদ্ধে কি দুর্নীতি চর্চার বা দুর্নীতি লালনের তেমন কোনো অভিযোগ আছে? আর আমাদের দেশে? অবিরামই তো বলা হচ্ছে যে, অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের কর্তৃত্বে এবং প্রধান দুই দলের আনুকূল্যে জাতীয় রাজনীতি এখন অসুস্থ, কলুষিত ও দুর্বৃত্তায়িত। একমাত্র এবং একমাত্র গণতন্ত্র চর্চা, গণতন্ত্রের অনুশীলন ও প্রয়োগই রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করা দুর্নীতির বীজ ও বিষ নির্মূল করতে পারে।
এটা নিশ্চিত করতে হলে এই মুহূর্তে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভুল স্বীকার ও সংশোধন করতে হবে। সবার অংশগ্রহণমূলক একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনে সম্মত হতে হবে সরকার পক্ষকে, সহিংসতা-নাশকতার পথ থেকে ফিরে আসতে হবে প্রধান সরকারবিরোধী পক্ষকে। তাদের উভয় পক্ষকে, বিশেষ করে উভয় নেত্রীকে অনুধাবন করতে হবে যে, তাদের ক্ষমতাকেন্দ্রিক বৈরী আচরণ ও বেপরোয়া কার্যক্রম দেশ ও জাতির ক্ষতি করছে। স্বাধীনতার গৌরব ও জাতির অপার সম্ভাবনা বিনাশ করছে। সবার প্রত্যাশা, দুই নেত্রী তাদের বর্তমান 'মাইন্ডসেট' পরিবর্তন করবেন এবং রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণ-চিন্তাকে প্রাধান্য দেবেন। জনগণ ফুঁসে ওঠার আগেই তাদের বিষয়টি ভাবা দরকার। জনগণ কি না করতে পারে! তিন সিটি নির্বাচন দুই নেত্রীর জন্যই এসিড টেস্ট। দখলের চিন্তা বা বর্জনের রাজনীতি কারোরই কোনো কাজে আসবে না। এই নির্বাচন হয়ে যেতে পারে জাতীয় রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট। হয় ভালো কিছু, নতুবা খুব খারাপ।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
ই-মেইল : [email protected]