একদিকে পেট্রলবোমা, অপরদিকে গুম, বন্দুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ারের ঘটনা- দুইয়ে মিলে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা আমাদের দেশের ইতিহাসে অতীতে কখনোই ছিল না। এর জন্য দায়ী দুটি বড় দল- বিরোধী ২০ দলীয় জোট বিএনপি ও জামায়াত এবং সরকারি দল। বিরোধী জোট যতই অস্বীকার করুক পেট্রলবোমার দায়ভার তাদেরই গ্রহণ করতে হবে। অন্যদিকে সরকারও যতই অস্বীকার করুক না কেন, এ পর্যন্ত সবকটি ক্রসফায়ার অথবা গণপিটুনির নামে রাষ্ট্রীয় সংস্থা কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যার দায়ভার তাদের নিতে হবে। তার সঙ্গে এই আমলে যুক্ত হয়েছে 'গুম' নামক ভয়ঙ্কর অপরাধটি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটা যে রাষ্ট্রীয় সংস্থাসমূহ করেছে তাও জনগণ বিশ্বাস করে। এই রকম বিশ্বাসের পেছনে যথেষ্ট প্রমাণও জনগণের কাছে আছে। একেবারে সাম্প্রতিক ঘটনা হলো সালাহউদ্দিন আহমেদের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনা। সবকটি রাষ্ট্রীয় আইন রক্ষাকারী সংস্থা নির্বিকারে বলেছে যে, এই নিখোঁজের ব্যাপারটি তারা জানেন না। নিখোঁজের ব্যাপারে তারা যে খুব একটা তৎপর তাও মনে হচ্ছে না। জনগণের বিশ্বাস বিরোধী দলকে দমন করার জন্য রাষ্ট্রই তাকে 'নিখোঁজ' করেছে, যার অপর নাম গুম।
সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হলো এই যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী গুম হওয়ার ব্যাপারে সরকারের দায়িত্বকে অস্বীকার করে উপহাসছলে মন্তব্য ছুড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'আট বস্তা ময়লার সঙ্গে তাকে পাচার করার জবাব খালেদা জিয়াই দিতে পারেন'। এমন তির্যক মন্তব্য প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আশা করি না। হয়তো তিনি রসিকতা করেছেন। কিন্তু বড় নির্মম রসিকতা। 'বাবু যত বলে পারিষদ-দল বলে তার শতগুণ।' প্রধানমন্ত্রীর এহেন মন্তব্য অন্যান্য মন্ত্রী, সরকারদলীয় নেতা-উপনেতাদের উৎসাহিত করেছে আরও বেশি। তারা প্রায় সবাই সুর মিলিয়ে বলতে শুরু করলেন, সালাহউদ্দিন আহমেদ নিজেই আত্দগোপনে গেছেন। মন্ত্রী হয়েছেন, তবু এতটুকু কাণ্ডজ্ঞান তৈরি হলো না যে, নিখোঁজ হলে খুঁজে বের করার দায়িত্ব কিন্তু সরকারেরই। অবশ্য সরকার এসব বিষয় নিয়ে সামান্যই মাথা ঘামায়। আর মন্ত্রীদের জিহ্বায় কোনো লাগাম বাঁধা নেই। মন্ত্রীদের বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য আগেও 'বাংলাদেশ প্রতিদিনের' পাতায় উল্লেখ করেছি, যা তাদের অর্বাচীন, বালখিল্যতার নিদর্শন তুলে ধরে। পুনরাবৃত্তি হলেও দুই একটি উদাহরণ আবারও উল্লেখ করছি। জনৈক মন্ত্রী বলেছেন, খালেদা জিয়ার বাসার সামনে বালুর ট্রাক রাখা হয়েছিল বাড়ি মেরামত করার জন্য। আরেক মন্ত্রী বলেছিলেন, খালেদা জিয়ার বাড়ির বিদ্যুতের লাইন কেটে দেওয়া হবে। হয়েও ছিল তাই। অন্য আরেক মন্ত্রী বললেন, খালেদা জিয়ার খাবার ও পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হবে। হলোও তাই। বাইরে থেকে খাবার আনতে বাধা দিল কর্তব্যরত পুলিশ। অন্য আরেক মন্ত্রী বলেছিলেন, পাকিস্তান দূতাবাসে তালা মেরে দেওয়া হবে। (এখনো পর্যন্ত তা করা হয়নি)। মন্ত্রীদের কথা শুনতে শুনতে হাসিও পায়, কান্নাও পায়। ভাবি 'হায় এ কোন দেশে বাস করছি'।
মন্ত্রীরা যখন আবোল-তাবোল বলে চলেছেন, তখন অবশ্য আওয়ামী লীগের নেতা ও বিদায়ী মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত অনেক দিন পর একটা বুদ্ধিমানের মতো কথা বলেছেন। জনাব সালাহউদ্দিন আহমেদের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, 'সালাহউদ্দিন আহমেদকে খুঁজে না পাওয়া রাজনীতির জন্য অশনি সংকেত।' বাস্তবিকই আমরা অশনি সংকেত লক্ষ্য করতে পারছি।
সালাহউদ্দিন আহমেদের স্ত্রী যখন অভিযোগ করেন, তখন পুলিশ পাল্টা অভিযোগ করেছিল যে, তিনি নাকি দেরিতে থানায় জিডি করেছেন। আসল কথা হলো প্রথমে থানা জিডি নিতে চায়নি। পুলিশ যে এই রকম আচরণ করে, জিডি নিতে চায় না, তা কোনো নতুন খবর নয়। সালাহউদ্দিন আহমেদের স্ত্রী যখন হাইকোর্টে গেলেন, তখন সবকটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বিকার বলে বসল যে, তারা কিছুই জানেন না। ব্যাস, তাদের দায়িত্ব শেষ। এরপর তদন্তে আর কী রিপোর্ট বের হবে, তা তো জানা কথা। জনগণও পুলিশের প্রতি সামান্যতম ভরসা রাখছে না। রক্ষক যদি ভক্ষক হয় তবে তো তারা বড় অসহায় বোধ করেন। এটাই পাবলিক পারসেপশন।
পুলিশ যাই বলুক, অথবা না বলে নির্বিকার থাকুক, তারা দায় কিন্তু এড়াতে পারবেন না। বহু সাক্ষী আছেন, যারা প্রত্যক্ষদর্শী। তারা বলছেন, তারা দেখেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনাব সালাহউদ্দিনকে তাদের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। তারপর থেকে নিখোঁজ। সালাহউদ্দিন আহমেদ একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। তিনি যে গোয়েন্দা পুলিশের নজরদারির মধ্যে ছিলেন, তা ধরে নেওয়া যায়। তবে তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল বলে জানা নেই। থাকুক বা নাই থাকুক, কাউকে গুম করার অধিকার কি পুলিশকে আইন দিয়েছে? এর আগের আরেকটি ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা এবং সাবেক মন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিব জনাব রিয়াজ রহমান, যাকে সবাই সজ্জন ব্যক্তি বলেই জানেন, তিনি হঠাৎ করে গুলিবিদ্ধ হলেন। কে বা কারা করেছে তা এখনো রহস্যাবৃত। তার পায়ে যে ধরনের বুলেট পাওয়া গেছে, তা নাকি সাধারণ সন্ত্রাসীদের কাছে থাকার কথা নয়। এসব হচ্ছে কি। হঠাৎ করে ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়ে গেল। বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য কত রকমের মিথ্যাচার করা হচ্ছে। সর্বশেষ যে কৌশলটি পুলিশ বা সরকার গ্রহণ করেছে তা হলো গণপিটুনির নাটক। নিজস্ব লোকজন দিয়ে গণপিটুনির নাটক সাজালেও না হয় বোঝা যেত। কিন্তু তাও নয়। গণপিটুনির কোনো ঘটনাই ঘটেনি। ঢাকার মিরপুরে তিন যুবককে স্রেফ গুলি করে হত্যা করে বলা হলো গণপিটুনিতে মারা গেছেন। পুলিশেরই ময়নাতদন্তের রিপোর্টে পাওয়া গেল, তিন যুবকের গায়ে মোট ৫৬টি বুলেটের চিহ্ন। তাহলে গণপিটুনিতে অংশগ্রহণকারী সাধারণ জনগণের হাতে কি রাইফেল ছিল? তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে পুলিশ করছিল কি? নাকি পুলিশই জনগণকে রাইফেল সরবরাহ করেছিল?
এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। উত্তরের নামে আরও যেসব মিথ্যা কথা শোনা যাবে, তা গোয়েবলসকেও হার মানাবে। আর পুলিশ জবাবদিহির ধারও ধারে না। কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশে পুলিশকে তো জবাবদিহি করতে হবে। হায় গণতন্ত্র! পুলিশের কাছে কে জবাব চাইবে? জনগণ পুলিশের কাছে চাইতে গেলে আবার না কোন বিপদ ডেকে আনা হবে। এবারের পার্লামেন্ট তো সত্যিকার অর্থে নির্বাচিত নয়। সেখানেও তাই এমন প্রশ্ন উত্থাপন করা হবে না, পাছে সরকার বিব্রত হয়। বুদ্ধিজীবীরা অথবা তথাকথিত সুশীল সমাজ হয়তো কথা বলতে পারেন। দুর্ভাগ্য এই দেশের। তারাও দ্বিধাবিভক্ত। এখানে অওয়ামীপন্থি অথবা বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী। নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা খুব কম। দলকানা বুদ্ধিজীবীরা বস্তুত স্বতন্ত্র সত্তা বহু আগেই হারিয়ে বসেছেন। আওয়ামীপন্থি বুদ্ধিজীবী বা সুশীল সমাজ পেট্রলবোমা নিয়ে প্রতিবাদ সভা করবেন, বিবৃতি দেবেন কিন্তু গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যার ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকবেন। অন্যদিকে বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবীরা অধিকাংশ হয় ভয়ে চুপসে গেছেন, অথবা সরকারের সমালোচনা করলেও পেট্রলবোমার ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকবেন। এ বড় দুর্ভাগ্যের বিষয়। এমনটা অতীতে কখনো ছিল না।
সংবাদপত্রে খুব সাবধানে হলেও কিছু কিছু লেখা হয়। তাও অবাধ স্বাধীনতা নেই। পটুয়াখালীর বাউফলের সাংবাদিককে পুলিশি হেফাজতে যেভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে তার কোনো প্রতিকার কি হয়েছে? বিজ্ঞ আদালত নির্যাতিত সাংবাদিক মিজানুর রহমানকে জামিন দেননি। তবে কারাগারে চিকিৎসার আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু নির্যাতনকারী পুলিশের কি বিচার হবে?
হঠাৎ করে পুরনো কথা মনে পড়ে গেল। খালেদা জিয়ার ২০০১-২০০৬ সালের প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে ক্লিনহার্ট অপারেশনের সময় অনেক নিরপরাধ ব্যক্তি নির্যাতিত হয়েছিলেন, অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। খালেদা জিয়া তখন পার্লামেন্টে আইন পাস করে নির্যাতনকারী যৌথবাহিনীর সদস্যদের জন্য দায়মুক্তি দিয়েছিলেন। আজকে যখন তার দলের কর্মীরা নির্যাতিত হচ্ছেন, তখন কি তার একবারও মনে পড়ে নিজের অতীতের কথা? সম্ভবত নয়।
বস্তুত এটা প্রমাণিত যে, এই দুটি বড় দল কেউই গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না। অতীতেও করেননি, এখনো করছেন না। পেট্রলবোমা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নয়। অন্যদিকে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যার রাজনৈতিক কালচার ফ্যাসিবাদী প্রবণতারই লক্ষণ মাত্র। আমরা এই দুই ধরনের রাজনৈতিক কালচারের অবসান চাই। বস্তুত একটা আরেকটাকে উসকে দিচ্ছে।
যত বেশি পেট্রলবোমা ব্যবহৃত হবে, তত বেশি সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে সরকার কর্তৃত্ববাদী, অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী হয়ে উঠবে। অন্যদিকে সরকার যত বেশি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস প্রয়োগ করবে, তত বেশি গোপন সন্ত্রাসী তৎপরতা বৃদ্ধি পাবে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও দলীয় সন্ত্রাস দুটোই বন্ধ করতে হবে। এর জন্য আমরা এখনো আশা করব, সব পক্ষের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। উভয় পক্ষই সন্ত্রাসের পথ পরিহার করে গণতান্ত্রিক পথে আসবে। বিরোধী পক্ষকে অবশ্যই ইতিমধ্যে অকেজো হয়ে যাওয়া অবরোধ-হরতাল প্রত্যাহার করতে হবে। কারণ অবরোধের সুযোগেই পেট্রলবোমার সন্ত্রাস বিস্তার লাভ করছে (যদি ধরেও নিই যে, বিএনপি এই কাজ করছে না)। অন্যদিকে সরকারকে স্বীয় উদ্যোগে ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে বিরোধী দল সংবিধানে বর্ণিত গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের পুরো সুযোগ নিতে পারে। সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদককে মুক্তি দিতে হবে এবং সবার জন্য সভা-সমিতির পরিপূর্ণ সুযোগ দিতে হবে। একই সঙ্গে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে হবে।
তারপর সব কার্যকর রাজনৈতিক দল (অবশ্যই জামায়াত বাদে), সুশীল সমাজ, শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধি, বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে মহাসংলাপের ব্যবস্থা করতে হবে, যেখানে নির্বাচনের বিষয়াদি, গণতান্ত্রিক আচরণের বিধিমালা ইত্যাদি আলোচিত হবে এবং আমরা একটা সাধারণ ঐকমত্যে পৌঁছতে সক্ষম হব। তবে এখন পর্যন্ত সেরকম সম্ভাবনা কমই দেখা যাচ্ছে। সেই ক্ষেত্রে আমরা বেশ দীর্ঘ সময়ের জন্য আরও গভীরতর অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে পারি বলেই আশঙ্কা হয়।
লেখক : রাজনীতিক।