অন্ধকারের কি রূপ থাকে? এক রাতে পূর্ণিমা দেখতে গিয়েছিলাম। সময়টা '৯৩ সাল। সঙ্গী বন্ধু ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী। তিনি তখন ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব। এখন পাট সচিব। আমি সিনিয়র রিপোর্টার ভোরের কাগজে। রাত নামলেই আমরা মাঝে মাঝে বের হতাম। ফরিদ ভাই ড্রাইভ করতেন। পাশে আমি। ঢাকায় তখন যানজট ছিল না। এত ঝামেলা ছিল না। ছিমছাম শহর। বিমানবন্দর সড়কটি ছিল ফাঁকা। উত্তরাকে মনে হতো নীরব শহরতলি। বিমানবন্দর পার হলেই সুনসান। আশুলিয়া সড়ক পুরোপুরি চালু হয়নি। সন্ধ্যার পর আশুলিয়ার দিকে কেউ যেতেন না। কিন্তু আমরা যেতাম। ভয়, ডর কম ছিল। মনের জোর ছিল অনেক বেশি। বর্ষায় আশুলিয়া সড়কের দুই তীরের পানির স্রোত আছড়ে পড়ত। তৈরি হতো অনেকটা কক্সবাজারের ভাব। আর বর্ষার সন্ধ্যায় বৃষ্টি দেখার আনন্দটাই ছিল অন্যরকম। সেদিন পূর্ণিমা দেখতে গিয়ে আমরা পেলাম কালো মূর্তির ঘন অন্ধকার। ঘড়ির কাঁটায় রাত ১১টা। অথচ মনে হচ্ছিল গভীর রাত। চারদিক জনমানবশূন্য। এক পসলা বৃষ্টির কারণে পূর্ণিমার চাঁদ ঢেকে গেছে মেঘের আড়ালে। আশুলিয়ার মাঝামাঝি গাড়ি থামালেন ফরিদ ভাই। হেড লাইটের আলো নিভিয়ে দিলেন। আমাদের হাতে কোকের ক্যান। ভরা পূর্ণিমার বদলে দেখলাম মায়াবী অন্ধকার। আলো-অাঁধারির খেলা। জোনাকির আলোতে ব্যাঙের ডাক। আর পানির ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার শব্দ। অসাধারণ মায়ার এক জাল। আমার মনে হয়েছিল অন্ধকারেরও রূপ থাকে। সেই রূপ দেখে নিতে হয়। বুঝে নিতে হয়। অনুভব করতে হয় হৃদয়ের ভিতর থেকে। সব কিছু দেখা যায় না।
বেশি দিনের কথা নয়। তবুও কোথায় যেন হারিয়ে গেল আমাদের সেই ঢাকা। এই ঢাকার প্রতিষ্ঠা মোগলদের হাতে। বিদ্রোহ বিপ্লবে বাংলা মুল্লুুক মোগলদের জন্য বড় ধরনের টেনশনের কারণ ছিল। ভারতবর্ষের অন্য এলাকাগুলো এত ঝামেলার ছিল না। এর মধ্যে বারো ভূঁইয়াদের যন্ত্রণায় সম্রাটরা ছিলেন অস্থির। পরিস্থিতি সামাল দিতে সম্রাট জাহাঙ্গীর ঢাকাকে বাংলার প্রাদেশিক রাজধানী করেন ১৬১০ সালের ১৬ জুলাই। এর আগে ১৬০৮ সালে ইসলাম খাঁ চিশতিকে নিয়োগ দেন বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজমহলের সুবেদার হিসেবে। ইসলাম খাঁ এসে দেখলেন রাজধানী বিহারে রাখার যৌক্তিকতা নেই। সব কিছু বাংলায়। ঢাকা হলো মধ্যমণি। এখানে রাজধানী হলে সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ চলে আসবে। ইসলাম খাঁ বাস্তবতা জানালেন মোগল বাদশাকে। অনেক চেষ্টায় বাংলাকে কাবু করার কথা মনে রেখেই এতে সম্মতি দেন বাদশাহ জাহাঙ্গীর। ইসলাম খাঁ ঢাকা এসেই হাত দেন উন্নয়নে। কারণ এই নগরের মানুষ উন্নয়নে খুশি হয়। বাস্তবেও তাই হলো। উন্নয়নে মুগ্ধ মানুষও খুশি হয়ে ঢাকার নামকরণ করে জাহাঙ্গীরনগর। কিন্তু তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। বাদশাহ জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর ঢাকার মানুষ সব ভুলে যায়। বুড়িগঙ্গায় আসে নতুন জল। ঢাকা আবার ফিরে আসে পুরনো নামে।
জাতি হিসেবে আমরা অনেক কিছু ভুলে যাই। তাই অকারণে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, জাতির জনককে নিয়েও বিতর্ক করি। '৮৮ সালের বন্যার কথা এখন অনেকের মনে নেই। অথচ ঢাকাবাসীর তখন একমাত্র বাহন ছিল নৌকা। মিরপুরের অধিবাসীরা ১ নম্বর অথবা ১০ নম্বর থেকে নৌকায় চড়তেন। নামতেন কলেজ গেট কিংবা খামারবাড়ি। মিরপুরের নৌকার মাঝি ডাকতেন যাবেন, ঢাকা, ঢাকা। আমি তখন পড়াশোনা করি। পাশাপাশি লেখালেখি করি সাপ্তাহিক সন্দ্বীপ নামের এক পত্রিকায়। পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক সালেম সুলেরির বাসা টিকাটুলি। নৌকায় চড়ে টিকাটুলি থেকে সুলেরি আসতেন মতিঝিলে। আমার কলেজ জীবনের বন্ধু আতিক তখন থাকে জাপানে। তার মা আমাকে দারুণ আদর করতেন। একদিন আতিকের মায়ের খোঁজে গেলাম তাদের কল্যাণপুরের টিনের একতলা বাড়িতে। কলেজ গেট থেকে নৌকায় চড়ে কল্যাণপুর। কিন্তু বাড়ি কোথায়? চারদিকে শুধু পানি আর পানি। সব কিছু ডুবে গেছে। ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুললাম। এ ছবিটি বন্ধুর কাছে পাঠাব জাপানে। পরে শুনলাম আতিকের মা পানির গতি দেখে বাড়ি ছাড়েন। চলে যান গোলাপবাগে বড় ছেলের বাড়িতে। '৮৮ সালের বন্যা এখন শুধুই স্মৃতি। টুকটাক মনে আছে এরশাদের হাঁটু পানিতে ঘোরাঘুরি করা। বিটিভি তার এই ঘোরাঘুরি নিয়ে একটি গান দেখাত, আজকের শেষ চেষ্টা আমার। সেই ঢাকার কথা অনেকেরই মনে নেই। বাঙালি এক আবেগী জাতি। সব কিছুতে পদ্মার ঢেউয়ের মতো উচ্ছ্বাস। আবার দ্রুত ভাটার টান। যে সাংবাদিক নেতারা বাকশালে যোগদানে বেশি উৎসাহী ছিলেন দলেবলে তারাই '৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর বেশি বঙ্গবন্ধুবিরোধী। হায়রে ইতিহাস!
ঢাকা নিয়ে অতীতকে টানার কারণ আছে। কারণটা হলো- এবারকার সিটি নির্বাচন। ঢাকা শহরে অনেক দিন কোনো জনপ্রতিনিধি ছিল না। ভোগান্তির শেষ ছিল না জনগণের। জন্ম, মৃত্যু সার্টিফিকেট নিতেও মহাঝামেলা। রাস্তাঘাট, মশার কথা বাদই রাখলাম। তাই এবারকার সিটি নির্বাচনে প্রাণের উচ্ছ্বাস। এই উচ্ছ্বাসে আরও জোয়ার তুলেছে বিএনপির নির্বাচনে ফিরে আসা। আমি মনে করি সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়া বিএনপির ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। কারণ এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিন কাটছে দলটির। নেতা-কর্মীরা বিপর্যস্ত হামলা-মামলায়। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিনের স্ত্রী জানেন না তার স্বামী কোথায় আছেন। ইলিয়াস কন্যার চোখে এখনো অশ্রু। আর এর বিপরীতে বিএনপি হরতাল ডাকলে এখন যানজট বাড়ে। শিথিল বললে যানজট কমে। অতি ব্যবহারে হরতালের মতো একটি রাজনৈতিক কর্মসূচিও মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। কোনো বাড়াবাড়ির যৌক্তিকতা নেই। মানুষ বাস্তবতায় দেখতে চায় রাজনৈতিক দলগুলোকে। চোরাগোপ্তা হামলা চালানো বিএনপির মতো দলের কাজ নয়। এই কাজ চরমপন্থি দলের। আর করতে পারে জামায়াতিরা। আমরা জানি বিএনপিতে অনেক সাবেক চরমপন্থি আছেন। তাই তারা গণসম্পৃক্ত একটি দলের সর্বনাশ করে সেদিকে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু অন্যরাও তা কেন মেনে নিচ্ছেন? বিএনপি বার বার ক্ষমতায় এসেছিল। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও তারা জয়ী হতে পারত। আওয়ামী লীগের কারচুপি করে জয়ের ক্ষমতা তখন ছিল না। তারপরও বিএনপি নির্বাচনে আসেনি। অকারণে গোয়ার্তুমি করে দলের সর্বনাশ করেছে। অন্যদিকে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক ধারাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সরকার তো চেষ্টা করবে বিএনপিকে ক্ষমতার বাইরে রাখতে। এটাই সরকারের কৌশল। কিন্তু বিএনপি সরকারের সেই কৌশলে পা দেবে কেন?
৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি অবাস্তব চিন্তা থেকে। বিএনপির দাবি ছিল একটাই- তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না। বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে আমরা কয়েকটি জরিপ করেছিলাম। সব জরিপেই এগিয়ে ছিল বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক না হলেও বিএনপি জয়ী হতো। কিন্তু বিএনপি নেতারা বাস্তবতায় ছিলেন না। তাদের মধ্যে এক ধরনের অহমিকা ভর করেছিল। ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে সবাই ব্যস্ত ছিলেন। কে কোন মন্ত্রণালয়ে বসবেন, দেশে-বিদেশে কার নিয়োগ কোথায় হবে সেসব নিয়েই ছিল ব্যস্ততা। আর অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কৌশল ছিল যে কোনো প্রক্রিয়াতে বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখা। রাজনৈতিক কৌশলের কাছে মার খায় বিএনপি। এখন তারা বুঝতে পেরেছে ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু ততক্ষণে নদীর পানি অনেক দূর গড়িয়েছে। সরকার পার করছে প্রায় এক বছর তিন মাস। বাকি দুই মাস যাবে সিটি নির্বাচনে। তারপর রমজান, বর্ষা। এরপর আসবে শীত। আর সেই শীত কতটা কাবু করবে সরকারকে তা আপাতত বলা মুশকিল। সব নির্ভর করছে বাস্তবতার ওপর।
কিন্তু বাস্তবতার নিষ্ঠুরতা মানুষকে সব কিছু থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। মানুষ তারপরও স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নকে জয় করার চেষ্টা করে। আমরা কেউই বাস্তবতার বাইরে নই। আমার এক শিক্ষক বন্ধু বললেন, কিছু মানুষ মনে করে শিক্ষকদের মন বলে কিছু নেই। তারা রোবট। মোটা চশমার আড়ালে তারা নিজেদের লুকিয়ে রাখবে। আমি এই বন্ধুর সঙ্গে একমত। কেউই রোবট নই। সবাই বাস্তব জগতের মানুষ। আর বাস্তবে আছি বলেই আমাদের এই স্বপ্নের ঢাকাকে আমরা রোবট নগরী হিসেবে দেখতে চাই না। ঢাকাকে গড়ে তুলতে হবে আধুনিক নগরী হিসেবে। বাস্তবতায় রাখতে হবে আমাদের প্রিয় শহরকে। যারা মেয়র নির্বাচিত হবেন অঙ্গীকার রক্ষা করতে হবে তাদেরকে। ভোটের পরে এমন কথা বলা যাবে না সমন্বয়ের অভাবে কিছু করতে পারছি না। নগরবাসীর ট্যাক্সে টাকায় সিটি করপোরেশন চলে। দুই ঢাকার কাজে সমন্বয় না থাকলে সব কিছু হোঁচট খাবে।
ব্যাহত হবে উন্নয়ন প্রক্রিয়া। উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় ইট পাথরের কাঠিন্য ভেদ করে এই শহরে সবুজের হাতছানি ফিরিয়ে আনতে হবে। যানজট দূর করতে হবে পরিকল্পিতভাবে। মাদক ও সন্ত্রাস দূর করতে হবে সম্মিলিত তৎপরতায়। নাগরিক হৃদয়ে দিতে হবে স্বস্তির ছোঁয়া। ফিরিয়ে দিতে হবে খেলার মাঠ, পার্ক, মানুষের হাঁটার ফুটপাথ। মেট্রোরেল, পাবলিক যানবাহন বাড়াতে হবে। নগরবাসীর পক্ষে সব অধিকার নিয়ে লড়তে হবে মেয়রকে।
আমরা জানি প্রার্থীরা এখন বাড়ি বাড়ি যাবেন। সুন্দর কথার ফুলঝুরি ছড়াবেন। ভোটাররাও প্রার্থীদের কথায় ভিজে ওঠবেন। কারণ ভোট মানুষের কাছে এক উৎসবের মতো। এই উৎসবে মানুষ অংশ নেয় আনন্দের সঙ্গে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে এখন আনন্দের জোয়ার বইছে। মানুষের সেই আনন্দ ধরে রাখতে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখবে বলেই বিশ্বাস করি। কোনো পক্ষপাত আমরা আশা করি না। নির্বাচন কমিশন অনেক শক্তিশালী। কোনো হুমকি, ধমকি তাদেরকে স্পর্শ করার কথা নয়। নির্বাচন কমিশনকে নিজেদের মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। প্রমাণ দিতে হবে তারা পুরোপুরি নিরপেক্ষ। আর ভোটারদের চিন্তা করতে হবে বাস্তবতার কথা। শুধু বক্তৃতাতে গলে গেলে হবে না। কোন প্রার্থী কাজ করবেন, সততা নিষ্ঠার সঙ্গে আমাদের প্রিয় শহর ঢাকা ও চট্টগ্রামকে ঢেলে সাজানোর জন্য শুধু তাদেরই বেছে নিতে হবে। বর্জন করতে হবে খারাপ, বিতর্কিত প্রার্থীকে।
পাদটীকা : ভোট সম্পর্কে নানামুখী মজার গল্প আছে। নির্বাচনের আগে এক প্রার্থীর বাড়িতে এলেন ভোটার। প্রার্থী নিজে ছুটে এলেন ভোটারের কাছে। প্রার্থীর স্ত্রী এলেন শরবত নিয়ে। কাজের লোকরা গলদ্ঘর্ম কি খাওয়াবে তা নিয়ে। ভোটার মহাখুশি। এতদিনে মনের মতো নেতা পাওয়া গেছে। এমন প্রার্থীকে বেছে নেওয়া দরকার। ভোটের পরে একে দিয়েই কাজ হবে। উন্নয়নের পাশাপাশি ফাও সেবাও মিলবে। মনে মনে নিজেকে গালও দিলেন দই-মিষ্টিজাতীয় কিছু না নিয়ে আসার জন্য। ভাবলেন, ভোট শেষ হলে একদিন আসবেন দই-মিষ্টি নিয়ে। ভোট শেষ হলো। সেই প্রার্থী জয়ী হলেন। ভোটার তো মহাখুশি।
তার প্রিয় প্রার্থী এখন ক্ষমতায়। এক সকালে কুমিল্লার রসমলাই, বগুড়ার দই আর টাঙ্গাইলের চমচম নিয়ে বিজয়ীর বাড়িতে গেলেন সেই ভোটার। মনের মধ্যে আনন্দ। অনেক গল্প, গুজব করে দুপুরে খেয়েদেয়ে বাড়ি ফিরবেন। নেতার দরজা খুলল কাজের লোক। রসমলাই, চমচম, দই নিয়ে চলে গেল ভিতরে। তারপর বলল, আজ স্যার মহাঝামেলায় আছেন। আপনাকে বলেছে, পরে এক সময় ফোন করে আসতে। আজ দেখা হবে না। কাজের লোকটিকে ভোটার বলল, একটু পানি মিলবে কি? কাজের লোকের চড়া গলা, ভোটের আগে এই বাড়িতে পানি মেলে। পরে মেলে না। এবার কেটে পড়ুন দয়া করে।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।