পয়লা বৈশাখ-১৪২২ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশপথে নারীদের শ্লীলতাহানির ঘটনায় নিন্দা ও সমালোচনার ঝড় বইছে সর্বত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় এ ধরনের ঘটনায় সারা দেশ স্তম্ভিত। প্রশাসনের নাকের ডগায় এবং হাজার হাজার মানুষের সামনে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার কয়েক দিন অতিবাহিত হলেও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার তো দূরের কথা শনাক্তও করতে পারেনি। জননিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ প্রশাসনের নির্লিপ্ততা ও তাদের দায়িত্বহীন বক্তব্যে আমরা ভীষণভাবে হতাশ হয়েছি। অন্যদিকে এ বিষয়ে ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন দায়িত্বশীল প্রক্টরের বক্তব্যও আমাদের আহত করেছে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি বর্ষবরণের এই জাতীয় উৎসবে নারীর অংশগ্রহণের অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করার অপপ্রয়াস ছাড়া আর কিছুই নয়।
১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনকালে এক তরুণী একই ধরনের ঘটনার শিকার হয়। এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি ১৮ জানুয়ারি-২০০০ একটি জনস্বার্থমূলক মামলা (মামলা নম্বর ২১২/২০০০) দায়ের করে। এ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বিভাগ ২৩ মে, ২০০৬ ঢাকা সিটি, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর সংলগ্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে পুলিশসহ সরকারের প্রতি বেশকিছু নির্দেশনা প্রদান করে। ১. প্রতিটি কমিউনিটি এলাকায় পুলিশের টহল বৃদ্ধি করতে হবে ২. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অসামাজিক কার্যকলাপ প্রতিরোধে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করবে ৩. বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিনিয়র প্রক্টোরিয়াল কমিটির সদস্যদের সমন্বয়ে একটি অপরাধ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করতে হবে ৪. পুলিশ স্টেশনে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সংঘটিত অপরাধের অভিযোগ জানানোর জন্য ২৪ ঘণ্টা হটলাইন নম্বর চালু করতে হবে ৫. স্থানীয় ও অরাজনৈতিক সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করতে হবে, যা পুলিশের কার্যক্রম মনিটরিং করবে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি ৭ আগস্ট-২০০৮ বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং কর্মস্থলে নারী ও শিশুদের প্রতি যৌন হয়রানি প্রতিরোধের দিকনির্দেশনা চেয়ে আরেকটি রিট (রিট পিটিশন নম্বর ৫৯১৬/২০০৮) দায়ের করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ মে-২০০৯ হাইকোর্ট কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সব সরকারি-বেসরকারি, আধা-সরকারি অফিস এবং সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি প্রতিরোধে একটি দিকনির্দেশনা প্রদান করে। ১. অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত পরিচালনা এবং সুপারিশ করার জন্য সরকারি-বেসরকারি সব কর্মক্ষেত্র এবং সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অভিযোগ গ্রহণের জন্য কমিটি গঠন করবে ২. কমপক্ষে ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হবে, যার বেশির ভাগ সদস্য হবেন নারী এবং সম্ভব হলে কমিটির প্রধান হবেন নারী ৩. কমিটির দুজন সদস্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে নিতে হবে, যে প্রতিষ্ঠান জেন্ডার এবং যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কাজ করে। পরবর্তীতে সমিতি ২০১০ সালে আরও একটি রিট পিটিশন (রিট পিটিশন নম্বর ৮৭৬৯/২০১০) দায়ের করে, যার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২৫ জানুয়ারি-২০১১ নিম্নোক্ত নির্দেশনা প্রদান করে। ১. প্রতিটি পুলিশ স্টেশনে যৌন হয়রানি-সংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণের জন্য পৃথক সেল থাকবে ২. স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য স্থানে যেখানে নারীদের অংশগ্রহণ থাকে সেখানে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে ৩. উপরোক্ত সেল জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটিকে এ উদ্দেশ্যে রিপোর্ট পেশ করবে।
কিন্তু এ পর্যন্ত উপরোক্ত নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়িত হয়নি, যার ফলে যৌন হয়রানির পুনরাবৃত্তি ঘটছে। কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থার অভাব এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশনা যথাযথভাবে মেনে চলার মাধ্যমে পাবলিক সেক্টরে শিক্ষাঙ্গন এবং কর্মস্থলে নারীর প্রতি যৌন হয়রানিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা সত্যিই দুরূহ কাজ। প্রাইভেট সেক্টরে যারা নিজস্ব বিধিবিধান দ্বারা পরিচালিত হয় তাদের ক্ষেত্রে এই চ্যালেঞ্জ আরও তীব্র। আশার কথা হচ্ছে- আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় অভিযোগ কমিটি গঠন করেছে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রেরণ করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ পুলিশের সদর দফতরে যৌন হয়রানিবিরোধী কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এঙ্পোর্টারস অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) কেন্দ্রীয়ভাবে যৌন হয়রানিবিরোধী কমিটি গঠন করেছে এবং তালিকাভুক্ত প্রায় ৩ হাজার তৈরি পোশাক কারখানাকে সুপ্রিমকোর্ট প্রদত্ত নির্দেশনা মেনে চলার জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রদান করেছে। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এঙ্পোর্টারস অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) অভিযোগ কমিটি গঠন করেছে এবং তাদের বিদ্যমান সদস্যসমূহকে নিজ নিজ কর্মস্থলে এই কমিটি গঠন করতে বিজ্ঞপ্তি প্রদান করেছে। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিরাপদ ও যৌন হয়রানিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আমাদের আহ্বান বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম, শিক্ষক, করপোরেট সেক্টর, এনজিও এবং অন্যদের সমন্বয়ে জাতীয় পর্যায়ে একটি মনিটরিং এবং পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করা হোক। এ কমিটি যৌন হয়রানি বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা কার্যকর করতে সক্রিয়ভাবে যথাযথ কৌশল অনুসন্ধান ও চিহ্নিত করবে।
২১ এপ্রিল-২০১৫ বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের (ভিসি) সঙ্গে দেখা করে এ ঘটনার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (শিক্ষা) ড. নাসরিন আহমেদের নেতৃত্বে ৭ সদস্যের কমিটি এ ঘটনা তদন্তে কাজ করছে বলে ভিসি জানান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণেরও আশ্বাস প্রদান করেন।
ঘটনার পর ১৫ এপ্রিল-২০১৫ বুধবার রাতে পুলিশ বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে। পুলিশের অবহেলার বিষয়, কাউকে আটকের পর ছেড়ে দিয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে ও তদন্তে সহযোগিতার জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলামকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে তদন্ত কমিটির কার্যক্রম হতাশাজনক। সাধারণ মানুষের ক্ষোভ আর রোষানল এড়াতে নামমাত্র তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও কমিটির কার্যক্রম কয়েকদিনের মধ্যে স্তিমিত হয়ে পড়ে। সময়ের আবর্তে ঘটনা সাধারণ মানুষসহ মিডিয়া ও সুশীল সমাজের কাছেও বিস্মৃত হয়। আশা করব, গঠিত কমিটি পূর্ব অভিজ্ঞতা ভুল প্রমাণ করে সময়োপযোগী সুপারিশমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবে। এ ছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী দায়েরকৃত মামলাটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তদন্ত কাজ সম্পন্ন করে এ ঘটনা যারা ঘটিয়েছে সে যেই হোক, যারাই হোক তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনবে এবং আইনে উল্লিখিত সময়ের মধ্যে বিচার কাজ সম্পন্ন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। পাশাপাশি দায়িত্ব অবহেলার জন্য সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি ভিকটিমদের পক্ষে আইনগত সহায়তা প্রদানে আগ্রহী। ভিকটিমরা সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাদের পরিচয় গোপন রেখে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের উপযুক্ত শাস্তির আওতায় আনা সহজ হবে। তবে সমিতি মনে করে এতদ্বিষয়ে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার চেয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি