লি-কুয়ান তার আত্দজীবনীতে বলেছেন, প্রতিদ্বন্দ্বীকে মোকাবিলা করার জন্য রাজনীতির একটা ধারালো অস্ত্র (কৌশল) তিনি সব সময় পকেটে রাখতেন এবং সেটা তিনি নির্দয়ভাবে ব্যবহার করেছেন লক্ষ্য অর্জনের পথে থাকা কাঁটা উপড়ে ফেলার জন্য। সিঙ্গাপুরের দিকে এখন তাকালে বোঝা যায় তার সেই ধারালো অস্ত্রের মূল লক্ষ্য ছিল জনগণের কল্যাণ ও অর্থনৈতিক উন্নতি। প্রায় পাঁচশ বছর আগে মেকিয়েভেলি বলে গেছেন, নীতি-নৈতিকতা এবং সরল সোজা পথ বলে রাজনীতিতে কিছু নেই। রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য সব কিছুই জায়েজ। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর বিস্ময় তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের সুযোগে গোপন পরিকল্পনা ও কথোপকথন অহরহ ফাঁস হয়ে যাওয়ার কারণে রাজনীতিক ও দলের অনৈতিক কর্মকাণ্ড, ভণ্ডামি ও বহুমুখী আচরণের কথা মানুষ সহজেই ধরে ফেলতে পারে বিধায় মেকিয়েভেলির তত্ত্ব অনুসরণ করে আজকাল সহজে পার পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত তিনটি সিটি কপোরেশনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মেকিয়েভেলির আচরণ প্রথম থেকেই মানুষের কাছে স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। হঠাৎ করে অপ্রত্যাশিতভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা, তার আগে ৯২ দিনের অবরোধ ও হরতালের নামে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডার বাহিনী কর্তৃক নিরীহ মানুষের ওপর আক্রমণ ও দেড়শ মানুষের জীবনহানি, নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত ও প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়ার ঘোলাটে অবস্থা ইত্যাদি দেখে বোঝা গিয়েছিল প্রধান দুই প্রতিপক্ষের জন্য সিটি নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের চেয়েও বড় লক্ষ্য ছিল এ নির্বাচন ও তার ফলাফলকে ব্যবহার করে নির্বাচন-উত্তর সময়ে কিভাবে জাতীয় রাজনৈতিক খেলার মাঠের হাওয়া নিজেদের পক্ষে আনা যায় বা রাখা যায়। অর্থাৎ এই নির্বাচনটিকে সব পক্ষ ব্যবহার করবে পরবর্তী রাজনৈতিক ছুরি চালানোর উপযুক্ত রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণের ভূমি হিসেবে। সরকারি দলের সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হলে সরকারি দল বলতে পারবে, জনগণ এই নির্বাচনের মাধ্যমে জামায়াত-বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও মানুষ হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছে। আর হেরে গেলে বলতে পারবে- বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যে হতে পারে তা আরও একবার প্রমাণিত হলো। সুতরাং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করে ভুল করেছে এবং তাই পরবর্তী নির্বাচনের জন্য বিএনপিকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অন্যদিকে বিএনপির লক্ষ্য ছিল এই নির্বাচনকে ব্যবহার করে কী কৌশলে সরকারকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি মধ্যবর্তী জাতীয় নির্বাচন দিতে বাধ্য করা যায়। সুতরাং বলা যায়, বড় দুই শরিক ওয়ানডে নয়, টেস্ট ম্যাচে জয় লাভের লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামে। এই লক্ষ্য অর্জনে জয়-পরাজয় যেটাই হোক না কেন, সেটিকেই বিএনপি কার্ড হিসেবে ব্যবহার করবে বলে প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছিল। জয় পেলে বলবে, অবৈধ সরকারকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই এই সরকারকে পদত্যাগ করে এখনই মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে হবে। আর পরাজিত হলে বলবে, ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে সরকারি দলের প্রার্থী জয়লাভ করেছে এবং তাতে প্রমাণ হয় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তৃতীয় পন্থা, অর্থাৎ ভোট শুরু হওয়ার মাত্র তিন ঘণ্টার মাথায় চট্টগ্রামে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে বিএনপি প্রমাণ করল রাজনৈতিক কৌশল উদ্ভাবনে তারা মেকিয়েভেলিকেও হার মানাতে জানেন। একেবারে টোটাল সারপ্রাইজ। কিন্তু এই কৌশল উদ্ভাবনের সেনাপতিরা হয়তো ভুলে গেছেন এটা একবিংশ শতাব্দী। ফলে বিএনপির ভোটাররা ভয়ানকভাবে প্রতারিত হলেন। তাদের ভোটগুলো পূর্ণতা লাভ করার আগে ভ্রূণ অবস্থায় সেটিকে হত্যা করা হলো। যাকে বলে বাধ্যতামূলক গর্ভপাত। তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা হতাশ, কিছু বোঝার আগেই বিনা মেঘে বজ্রপাত। এমনিতেই ধাওয়ার ওপর আছে, এখন তো পালানোর জায়গাও পাবে না। রাজশাহী শহরের বিএনপির একজন নামকরা অ্যাক্টিভিস্ট বললেন, কয়েকজন সুবিধাবাদী নেতা এবং কিছু কর্মচারী বেগম জিয়া ও তারেক জিয়াকে শেষ করে দিচ্ছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে বিএনপি একটি বাজে উদাহরণ সৃষ্টি করল এবং সাংঘর্ষিক অবস্থা থেকে উত্তরণের যে একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল তা বোধ হয় আবার নেই হয়ে গেল। যে প্রক্রিয়ায় ও পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিল তাতে বোঝা যায় এই সিদ্ধান্ত পূর্ব-পরিকল্পিত এবং মেয়র পদে জয়ী হওয়ার থেকেও বৃহত্তর কোনো লক্ষ্য অর্জনের প্রত্যাশায় বিএনপি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কতকগুলো বিষয়ের ওপর নজর দিলে পূর্ব-পরিকল্পনার ঘটনাটি বোঝা যায়। এক. স্থানীয় নির্বাচন বিধায় অফিসিয়ালি বিএনপি দলগতভাবে বর্জনের সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। ঢাকার জন্য এ সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত আদর্শ ঢাকা আন্দোলনের নেতারা, যারা ঢাকায় বিএনপির পক্ষে প্রার্থী দিয়েছে। এতে মনে হয়, মেয়র পদে জয়ী হওয়ার একটা সম্ভাবনা মনে মনে পোষণ করতেন বলেই নিজের কৃতিত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য এমাজউদ্দীন হয়তো বর্জনের বিপক্ষে ছিলেন। রাজনীতির মারপ্যাঁচ ও মেকিয়েভেলির তত্ত্বে রাজনীতিকরা যত পারদর্শী হন, ঠিক ততটুকুু আনাড়ি হয়ে থাকেন রাজনৈতিক পণ্ডিতরা। সুতরাং বর্জনের ঘোষণা চট্টগ্রামে মনজুর আলমের দ্বারা করানো হলেও ঢাকায় এমাজউদ্দীনের জন্য অপেক্ষা করেননি বিএনপির শীর্ষ নেতারা। আর ঢাকার প্রার্থী রাজনৈতিক নাবালক তাবিথ আউয়াল এবং মির্জা আব্বাসের প্রঙ্ িঘরের বধূ আব্বাসের স্ত্রী, দুজনই রাজনৈতিক মারপ্যাঁচের হাতের পুতুল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন। চার ঘণ্টা সময় হাতে থাকতে নির্বাচনী বিধিমালা অনুসারে কোনো চেষ্টা না করেই এবং অভিযোগের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার সব প্রক্রিয়াকে উপেক্ষা করে নিজেরা কিছু বোঝার আগেই বলির পাঁঠার মতো ঢাকার দুই মেয়র প্রার্থী কোরবানি হয়ে গেলেন। এর নামই বাংলাদেশের রাজনীতি। দুই. ২৯ এপ্রিল দৈনিক ইত্তেফাকের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- তিন সিটিতে ভোটকেন্দ্র প্রায় ২ হাজার ৭০০। তার মধ্যে গোলযোগ হয়েছে মাত্র ৫৫টি কেন্দ্রে। শতকরা হিসাবে দুই ভাগের কম কেন্দ্রে গোলযোগ হয়েছে। আর সর্বমোট ৬০ লাখ ভোটারের মধ্যে গোলযোগ হওয়া কেন্দ্রগুলোর মোট ভোটারের সংখ্যা প্রায় এক লাখের মতো। এই পরিসংখ্যান অনুসারে গোলযোগ সৃষ্টি হওয়া কেন্দ্র ও তার ভোটারের সংখ্যা মেয়র পদের ফলাফল নির্ণয়ে তেমন কোনো প্রভাব রাখে না। তা ছাড়া অভিযোগের ভিত্তিতে ২৫টি ভোটকেন্দ্রের ভোট গ্রহণ সাময়িক বন্ধ করে দেন এবং তিনটি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত ঘোষণা করেন নির্বাচন কমিশন। তিন. ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার মাত্র তিন ঘণ্টার মাথায় যেসব অভিযোগ তুলে মনজুর আলম বর্জনের ঘোষণা দিলেন সেগুলো তিনি নির্বাচন কমিশনকে জানিয়ে সম্পূর্ণ নির্বাচন স্থগিত করার দাবি জানাতে পারতেন। স্থগিত করার পূর্ণ ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের প্রতিক্রিয়া দেখার পর মনজুর আলম বর্জনের সিদ্ধান্ত নিলে তার কিছু যৌক্তিকতা থাকত। পাঁচ ঘণ্টা সময় হাতে থাকায় তিনি সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। পরিকল্পিত ছক অনুসারে হয়তো মনজুর আলমকে কাজ করতে হয়েছে। বিএনপির সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা হয়তো ভেবেছেন আরও দুই-তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করলে মনজুর আলম জয়ী হয়ে যেতে পারেন এবং তাহলে বিএনপির কাটা ছক হয়তো আর কাজে লাগবে না। তাই যথেষ্ট সময় থাকতেই বিএনপি বর্জনের ঘোষণা দিয়ে দেয়। চার. চট্টগ্রামে আ জ ম নাছির ও মনজুর আলমের প্রাপ্ত ভোটের যে ব্যবধান তাতে মনজুর আলম নিজে বলেছেন, বর্জন না করলে তিনি বিজয়ী হতেন। তবে শেষ পর্যন্ত মনজুর আলম থাকলে উভয়পক্ষের আরও ভোট পড়ত, প্রদত্ত ভোটের হার বেড়ে যেত, তাতে চূড়ান্ত ফল কি হতো তা সঠিকভাবে বলা না গেলেও মনজুর আলমের বিজয়ী হওয়ার প্রত্যাশার মধ্যে যুক্তি আছে, সেটা সবাইকে মেনে নিতে হবে। মনজুর আলম আরও বলেছেন, নির্বাচনের দিন সকাল থেকে বিএনপির নেতারা ঘর থেকে বের হয়নি, পোলিং এজেন্ট কেন্দ্রে যায়নি। তারপরও কেন্দ্রগুলোতে মনজুরের পক্ষে যেভাবে বিপুলসংখ্যক ভোট পড়েছে সে সম্পর্কে তার নির্বাচনী প্রধান এজেন্ট ও প্রধান সমন্বয়কারী দুজনের কেউ-ই তাদের চেইন অব কমান্ডের মারফত মনজুরকে সঠিক তথ্য দেয়নি। ফলে মনজুর আলম এক প্রকার প্রতারণার শিকার হয়েছেন। যা তার ছলছল চোখের ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে। মনজুর আলম ভোটের দিনই বলে দিয়েছেন, তিনি অপরাজনীতি করতে চান না বলেই রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দিলেন। কথাটি খুবই অর্থবহ ও ইঙ্গিতপূর্ণ। সরল-সোজা মানুষ বলে মনজুর আলমের একটা পরিচিতি আছে। ভবিষ্যতে তিনি আর অপরাজনীতির শিকার হতে চান না। সুতরাং মনজুর আলমের নিজের বিশ্লেষণে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকাসত্ত্বেও বর্জনের ঘোষণা এবং অপরাজনীতি করবেন না বিধায় রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানো- এ কথাগুলোতে স্পষ্ট হয় জয়ী হওয়ার জন্য নয়, বর্জন করার জন্যই বিএনপি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশ প্রতিদিনে বিএনপির একজন প্রভাবশালী নেতা ও একজন কর্মীর মধ্যে ভোট বর্জন সম্পর্কিত পূর্ব-পরিকল্পিনা ও তার পন্থা নিয়ে গোপন ফোনালাপের একটা তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। বিএনপি কেন এমন নাটকীয়ভাবে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিল সে সম্পর্কে বাজারে দুই ধরনের কথা হচ্ছে। প্রথমত. ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল, তাদের ভাষায় ৯২ দিনের কঠোর আন্দোলনের যৌক্তিকতা আছে এবং শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে জাতীয় নির্বাচন করা যাবে না- এ কথাগুলো প্রমাণ করার জন্য তারা আকস্মিকভাবে বর্জনের ঘোষণা দেয়। ইতিমধ্যে বিএনপির প্রভাবশালী সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদ নির্বাচন-উত্তর বক্তব্যে বলেছেন, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব নয় সেটি প্রমাণিত হলো এ নির্বাচনে।
বাজারে চালু দ্বিতীয় কথাটি একটু বিস্তৃত ও গভীর। অনেকের ধারণা, বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা মনে করেন বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার দ্বারা বিএনপিকে আর ভবিষ্যতে টিকিয়ে রাখা যাবে না। তাই একটার পর একটা কুবুদ্ধি দিয়ে এবং অপরাজনীতির পথে শর্টকাট রাস্তায় ক্ষমতা দখলের প্রলোভন দেখিয়ে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের রাজনীতির শেষকৃত্য সম্পন্ন করা। তারপর দলকে ঢেলে সাজানো এবং বিএনপিকে একটা আধুনিক প্রগতিশীল দল হিসেবে বিশ্ব দরবারে গ্রহণযোগ্য করা। সুতরাং বর্জনের চিন্তা ছিল সুপরিকল্পিত। মাঝপথে বেচারা তাবিথ আউয়াল ও মনজুর আলম আম-ছালা দুটোই হারালেন।
লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
ই-মেইল : [email protected]