আজ কত দিন ঘর ছাড়া ফুটপাতে। এর মধ্যে কত কিছু হয়ে গেল। বিশেষ করে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত চুক্তি লোকসভা ও রাজ্যসভায় সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন। ভারতীয় লোকসভায় অনেক কিছুই সর্বসম্মতিক্রমে হয় না। কেউ না কেউ কোনো না কোনো বিষয়ে আপত্তি তোলে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের আন্তরিক সহযোগিতা ছিল সর্বসম্মত। আর অনেক দিন পরে এই প্রথম '৭৪-এর ইন্দিরা-মুজিব সীমান্ত চুক্তির অনুমোদনে সংবিধান সংশোধন বিল পাস হয়েছে সর্বসম্মতিক্রমে। এ জন্য মহান ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ভারতের সবকটি দলের নেতা-নেত্রীসহ সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলোকে ১৬ কোটি বাঙালির পক্ষ থেকে অভিনন্দন মোবারকবাদ জানাচ্ছি। বাংলাদেশ সরকার এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকেও তার এই অভাবনীয় কূটনৈতিক সাফল্যের জন্য আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। ব্যাপারটি যেমন আমাদের কোনো দল বা গোষ্ঠীর নয়, তেমনি ভারতেরও একা কারও নয়। জিনিসটি দুই দেশের জাতীয় ব্যাপার। এখানে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে ভারতীয় নেতৃবৃন্দ যতটা সফলতার পরিচয় দিয়েছেন আমরা ততটা দিতে পারিনি।
অতি সম্প্রতি ব্রিটেনের নির্বাচন আমাদের আরেক জাতীয় সাফল্য। ব্রিটেন আমাদের ২০০ বছর গোলাম করে রেখেছিল। সেই ব্রিটেনে আমাদের বংশোদ্ভূত বাঙালি নারীরা পার্লামেন্টের সরাসরি ভোটে জয়ী হয়ে এক গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাস রচনা করেছে। এর আগেও বিলাতের পার্লামেন্টে রুশনারা আলী নামে আমাদের এক নারী সদস্য ছিল। কিন্তু এবার তিনজন জয়ী হয়ে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে। তার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র এবং শফিক সিদ্দিক ও রেহানার অতি আদরের দুহিতা টিউলিপ রেজওয়ান সিদ্দিক রয়েছে। টিউলিপের বিজয়ে আমরা খুবই খুশি ও আনন্দিত হয়েছি। নির্মমভাবে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর খুব কঠিন সময়ে টিউলিপের জন্ম। শেখ রেহানা ভীষণ কষ্ট করে জীবন চালিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও রেহানাকে রক্তের সম্পর্কের বোন হিসেবেই মনে করতাম, তারাও আপন ভাই ভাবতেন। কখনো সখনো এখনো ভাবেন। ববি, টিউলিপকে কোলে কাঁখে নিয়েছি, তাই সব সময় তাদের কথা মনে হয়। কয়েক মাস হলো গ্রামে গ্রামে থাকি বলে রেডিও-টেলিভিশন খুব একটা শুনি না, দেখি না- তাই সব সময় সব খবর পাই না। অবস্থানের ১০০তম দিনে টাঙ্গাইল শহীদ স্মৃতি পৌর উদ্যানে ছিলাম। বহুদিন পর বিপুল লোকজনের মধ্যে শহীদ মিনারে দুকথা বলার চেষ্টা করেছি। বলবার চেষ্টা করেছি, রক্ত দিয়ে যে স্বাধীনতা এনেছি, প্রয়োজনে জীবন দিয়ে তা রক্ষা করা উচিত। এও বলেছি, হুজুর মওলানা ভাসানী নেই, জননেতা শামসুল হক নেই, আ. মান্নান, ড. আলীম আল রাজি চলে গেছেন, শাজাহান যাওয়ার পথে, লতিফ সিদ্দিকী আসমান থেকে খসে পড়া তারার মতো কক্ষচ্যুত। টাঙ্গাইলের মানুষ শুধু হানাহানিই করল। যেহেতু কেউ বড় হলো না, উপযুক্ত হলো না, কদিন পর তাই তাদের পরিচয় দেওয়ার কেউ থাকবে না।
এরপর গিয়েছিলাম চৌহালী। একটা জনপদ নদীগর্ভে এভাবে বিলীন হয়ে যেতে পারে ইতিহাসে নজির থাকলেও চোখে দেখিনি। ১৫-১৬ বছর আগে চৌহালী গিয়েছিলাম। চমৎকার বাজার-ঘাট, অফিস-আদালত, বিশাল বিশাল গাছপালার ছায়ায় সেবার কিছু সময় সিক্ত হয়েছিলাম। চৌহালী যাওয়ার আগে সেই মধুর স্মৃতির অনেকটাই মনের মণিকোঠায় জমাট বেঁধেছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে কিছু পেলাম না, সব যমুনা নদীগর্ভে। মূল শহর থেকে ৩-৪ মাইল পূর্ব-দক্ষিণে চৌহালী কলেজ- সেটাই এখন ভরসা। তবে এভাবে ভাঙন অব্যাহত থাকলে বহুদিনের সুপ্রতিষ্ঠিত নাগরপুর জনপদ বিলীন হয়ে যেতেও খুব একটা সময় লাগবে না। চৌহালী থেকে নাগরপুর কলেজ মাঠে ঘাঁটি গেড়েছিলাম। পরীক্ষা ছিল বলে সারা দিন চুপচাপ ছিলাম। কলেজ মাঠের পাশে পুকুরঘাটে ছোট্ট এক খোলামেলা আড়চালা, তাতেই ছালা পেঁচিয়ে রাত কাটিয়েছি। নাগরপুরে আমাদের তেমন সংগঠন নেই, কিন্তু সাধারণ মানুষের উৎসাহ আমায় বড় বেশি অভিভূত করেছে। দিলীপ ধর সেন্টু এবং অন্যরা ভীষণ তৎপরতা দেখিয়েছে। ফেরার পথে খোরশেদ মার্কেটের ঠাণ্ডু এক পথসভায় দাঁড় করিয়েছিল। সব মিলিয়ে চৌহালী-নাগরপুর সফর খুবই ভালো লেগেছে।
পরপর কয়েকবার ভূমিকম্পের পর কেন যেন স্ত্রী-পুত্র-কন্যার সানি্নধ্যের জন্য মন বড় বেশি আনচান করছিল। কুশিমনিটাই এখন আমাদের ছায়া মায়ার আধার। ওর যেমন আমাদের ছাড়া চলে না, আমাদেরও চলে না ওকে ছাড়া। ফোনে কথা বলে আশা মিটছিল না। ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে খেতে চাচ্ছিল। তাই অবস্থানের ১০২তম দিনে জুমার নামাজ আদায় করতে বাড়ির পাশে মসজিদে এসেছিলাম। দীপ-কুঁড়ি-কুশির মাও ছেলেমেয়ে নিয়ে এসেছিল। বহুদিন পর ছেলেমেয়েকে পেয়ে বিশেষ করে কুশিকে কোলে নিয়ে বুক জুড়িয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল মায়ের কোলে আছি। পরদিন সকালে লোকজনের সঙ্গে কথা বলছিলাম, হঠাৎই শোক সংবাদ। প্রথম প্রথম বুঝতে পারিনি। পরে বুঝলাম, আমাদের প্রিয় ছোট বোন জামাই আশরাফুজ্জামান পাশার মৃত্যু সংবাদ (ইন্না লিল্লাহি ... রাজিউন)। আচমকা পাশার মৃত্যু সংবাদ শুনে হৃদয়ের বোঁটা ছিঁড়ে যেতে উপক্রম হয়েছিল। স্ত্রীকে নিয়ে থানাপাড়ায় পাশার লাশ দেখতে গিয়েছিলাম। অনেক দিন পর পাশার মুখ দেখে বড় শান্ত, নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে বলে মনে হলো। ফিরে এসে গাড়িতে বসেছিলাম। আমার স্ত্রী নাসরীন পিছে পড়েছিল। কোথাও গেলে সে সব সময় পিছে পড়ে। কারণ সবাই তাকে ছেঁকে ধরে। গাড়ির দরজার পাশে এক মহিলাকে এনে বলছিল, 'তুমি একে চিনো? পাশা যে পরে বিয়ে করেছিল ইনি সেই।' শোকাতুর ছোট্ট এক মহিলা বললেন, 'ভাই, নয় বছরের একটি বাচ্চা রেখে গেছেন। তাকে আপনি ভাগনী পরিচয়ে এবং রোমেল গালিব যেন বোনের অধিকার এবং পরিচয় থেকে বঞ্চিত না করে।' আচমকা পাশার মৃত্যু আমাকে মস্ত ধাক্কা দিয়েছিল। কিন্তু একজন অসহায় মহিলার সামান্য কটি কথা তারচেয়েও বেশি নাড়া দেয়। প্রায় ২০ বছর রহিমার সঙ্গে পাশার ছাড়াছাড়ি। রহিমাকে আমরা বড় বেশি ভালোবাসতাম, আদর করতাম। সে কিছুটা খেয়ালি স্বভাবের ছিল। কিন্তু পাশার সঙ্গে ওর বিচ্ছেদ অন্য কার কি হয়েছিল জানি না, কিন্তু আমার হৃদয় ভেঙে খানখান করে দিয়েছিল। উপরন্তু একজন কৃশ্চিয়ানকে বিয়ে করা আরও বেদনার ছিল। স্বাধীনতার পর পাশা আমাদের পরিবারের প্রথম জামাই। থানাপাড়া আহম্মদ মোক্তারের ছেলে পাশাকে আমি খুব একটা জানতাম না। তার ছোট ভাই আলিমুজ্জামান রাজু আমাদের সঙ্গে রাজনীতি করত। পাশার বাবা ছিলেন টাঙ্গাইলের একজন স্বনামধন্য মানুষ। অর্থ বিত্ত খ্যাতি কোনো কিছুই তার কম ছিল না। মুসলিম লীগের রাজনীতি করলেও মানুষ হিসেবে ছিলেন অসাধারণ। মতের ভিন্নতা সত্ত্বেও আমাদের আদরযত্ন এবং যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন। বাবার কিছুটা আপত্তি থাকলেও পাশার সঙ্গে রহিমার বিয়েতে পরিবারের আর কারও কোনো আপত্তি ছিল না। বরং সবাই খুশি ছিল। প্রথম প্রথম ওরা খুবই আনন্দে ছিল। পাশা আর রহিমার প্রথম সন্তান রোমেল। কি যে যত্ন পেয়েছে বলার মতো না। স্বাধীনতার পর রহিমার বিয়ে আমাদের বাড়ির প্রথম অনুষ্ঠান। কত মানুষ এসেছিলেন- রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, মাননীয় মন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, সোহরাব হোসেন, মিজানুর রহমান চৌধুরী, কামরুজ্জামান, যুব নেতা শেখ ফজলুল হক মণি, আ. রাজ্জাক, শেখ শহীদ, বীরউত্তম জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, শাফায়াত জামিল। স্বাধীনতার পরপরই হাইকোর্টের মাজারের নুরা পাগলা সালেকা মালেকা গান গেয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। চার চাকার দুই ঘোড়ার গাড়ি হাঁকিয়ে ৩০০-৪০০ ভক্ত নিয়ে নুরা পাগলা হাজির হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু কাজের জন্য হয়তো বিয়েতে আসতে পারেননি। বাবা-মাকে সান্ত্বনা দিতে রাতে এসেছিলেন। সারা জীবনে শুধু স্বাধীনতার পরই কিছু সময় আমরা কিছুটা আনন্দ ও স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলাম। কিন্তু '৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যা আমাদের ওপর আসমান ভেঙে পড়ে, সোনার সংসার ভেঙে খানখান হয়ে যায়। রক্ত ঘামে যে দেশ স্বাধীন করেছিলাম, সেই দেশে আমার বাবা-মা, ভাই-বোন পালিয়ে থেকে এক সময় ত্রিপুরা হয়ে পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে আশ্রয় নেয়। একপর্যায়ে রোমেলকে নিয়ে রহিমা ও পাশা সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে ধরা পড়ে ডিজিএফআইর মেজর কামরুল ইসলামের হেফাজতে থাকে। মেজর কামরুল ইসলামের বাবা-মা রহিমাকে নিজের মেয়ে এবং পাশাকে মেয়ের জামাইর মতো আদরযত্ন করেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রায় ছয় বছর পর রহিমার সঙ্গে যখন দেখা হয় তখন মেজর কামরুল এবং তার বাবা-মার কতই যে প্রশংসা করেছিল যা লিখতে গেলে এক বিরাট কিতাব হয়ে যাবে। আবার ওই সময়ই দেখেছি, ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল এলাকার ডিজিএফআইর মেজর হেলাল মোর্শেদ বঙ্গবন্ধুর প্রতিরোধ সংগ্রামীদের মেরে কেটে পিঠের ছাল তুলে ফেলেছে। সেই হেলাল মোর্শেদ মেজর জেনারেল হিসেবে অবসরে গিয়ে এখন বর্তমান সরকারে খুবই প্রিয়। বঙ্গবন্ধুর অনেক প্রকৃত অনুরক্ত ভক্তদের ল্যাং মেরে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সমর্থনহীন চেয়ারম্যান হয়ে বসে আছেন। আজ পাশা নেই, কত কথা মনে পড়ে। আমার প্রথম বই 'স্বাধীনতা '৭১'-র জন্য যা যা প্রয়োজন ছিল প্রায় সব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে অধ্যাপক শামসুল হুদা আর তাকে সহযোগিতা করেছে আশরাফুজ্জামান পাশা। আমি যখন নির্বাসনে ছিলাম তখন সে ঘন ঘন চিঠি লিখত। সেসব চিঠিতে তখনকার চমৎকার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ থাকত যাতে প্রচুর উপকৃত হতাম।
বেশ বড়সড় রোমেলকে নিয়ে রহিমা বর্ধমানে যায়। কোলের রোমেল তখন ছোটাছুটি করত। ৪-৫ দিন পর খাওয়ার টেবিলে আমার গলা ধরে বলেছিল, 'জানো মামা, আমাদের স্কুলের এক এসপির ছেলে বঙ্গবন্ধুকে চোর বলেছে। বলেছে, বঙ্গবন্ধুর চৌদ্দ গোষ্ঠী চোর। বঙ্গবন্ধুর চৌদ্দ গোষ্ঠী চোর হলে তুমি তাতে পড় না?' অাঁতকে উঠে বলেছিলাম, 'কী বলিস? বঙ্গবন্ধু চোর হলে আমরা সবাই চোর। চৌদ্দ গোষ্ঠী লাগবে কেন? আমরা তার ১-২ গোষ্ঠীর মধ্যেই পড়ি। কী অবাক দুনিয়া! হয়তো চৌদ্দ গোষ্ঠী চোর বলারাই এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে, আমরা চার চৌদ্দং বিয়ালি্লশ গোষ্ঠীতেও নেই। এমনি কত কথা যে মনে পড়ছে। রহিমা একটু জেদি স্বভাবের, অস্থির। সব কিছুতেই খুব সহজেই ভেঙে পড়ে। সারা জীবন ওর স্বভাব বদলাতে পারেনি। স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের পর ছেলে দুটিকে বুকে আগলে ছিল। বহু কষ্ট করে মোহাম্মদপুরে বাড়ি করেছে। তারপর রেডক্রসে কাজ করত। সেই কাজ করতে করতে স্বদেশ, বিদেশ সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাশার মৃত্যু আমার বুকের পাঁজর ভেঙে দিয়েছে। ছেলে দুটির বাবার সঙ্গে তেমন সম্পর্ক ছিল না। বলতে গেলে একেবারে আলাদা ছিল। এটা যে ভালো নয়, কেউ থাকতে তা কেউ বুঝে না, বুঝতে চায় না। কী দুর্ভাগা সন্তান! তার পিতার সব সম্পদ পাবে, কিন্তু শেষ দেখা দেখতে পেল না। একজন আমেরিকায়, অন্যজন ইংল্যান্ডে। থানাপাড়া টাঙ্গাইল দারুল উলুম আলিয়া (কামিল) মাদ্রাসায় পাশার জানাজা হয়। থানাপাড়ার আদি বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও জানাজায় কেউ ছিল বলে মনে হলো না। এ এক অবাক কাণ্ড! পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ, নামাজিতে ভরা, কিন্তু জানাজায় লোক নেই। কারও তেমন দয়া-মায়া নেই, আবেগ-বিবেক নেই, বুকফাটা ভালোবাসা নেই। সবাই কেমন যেন যান্ত্রিক হয়ে গেছে। পাশার মৃত্যুতে মনটা বড় ভারি ছিল। দীর্ঘদিন পর স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে নিয়ে খেতে বসেও শান্তি পাচ্ছিলাম না। মনের মণিকোঠায় বারবার পাশার মুখ ভেসে উঠছিল। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, আল্লাহ যেন তার সব পাপ মার্জনা করে তাকে বেহেশতবাসী করেন।
ছেলেমেয়েরা ঢাকা চলে গিয়েছিল। অসহায় একা পেয়ে যন্ত্রণার বেদনা যেন হিমালয়ের মতো ভারি হয়ে বুকে চেপে বসেছিল। শুধু বারবার পাশার মুখ মনে পড়ছিল। বারবার মনে হচ্ছিল কীভাবে আপন পর হয়, পর হয় আপন। ১০২ দিন কোনো ঘরে শুইনি। সেদিনই প্রথম নিজের বিছানায় শুয়েছিলাম। এই ১০৩ দিনে ছেলেমেয়ের ফোন ছাড়া আর নির্দিষ্ট ৪-৫ জনের ফোন ধরেছি। ফোন চার্জে ছিল। মনে হয় রাত পৌনে ১১টা হবে, ঝনঝন করে ফোন বেজে উঠেছিল। কেন যেন চোখ পড়তেই দেখি রেহানার ফোন। ওরকম সময় সাধারণত রেহানা ফোন করে না। আমি কথা বলি বিকাল ৩-৪টায়। হ্যালো বলতেই রেহানার কণ্ঠ, 'ভাই, ঘুম ভাঙলাম না তো? আপনার ভাগনি টিউলিপের বিজয়ের খবর দিতে ফোন করেছি। ভাবলাম খবর পেলে আপনি খুবই খুশি হবেন। যে মেয়েকে কোলে নিয়েছেন সে আজ আপনাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে। যেখানেই থাকুক আপনি মামা। দুটা মা একত্র করলে মামা হয়। আপনার দোয়া ওদের জন্যে খুবই প্রয়োজন। তাই আপনাকে ফোন করলাম।' সত্যিই রেহানার ফোন পেয়ে অসম্ভব খুশি হয়েছিলাম। আমার স্ত্রী, ছেলেমেয়েরাও ভীষণ খুশি হয়েছে। মৃত্যুর মধ্যেও জীবনের আনন্দ খুঁজে পেয়েছিলাম। বলেছিলাম, মামনি কেমন আছে? মাকে আমার অভিনন্দন, শুভ কামনা ও অনেক অনেক শুভেচ্ছা। মাঝে বেশ কয়েকবার তোমাকে ফোন করেছি। কিন্তু পাইনি। ববিকেও বলেছি। প্রয়োজনীয় কথা ছিল, বলতে পারিনি। তোমার ভাবীও বলতে চেয়েছিল। সেও পারেনি। সঙ্গে সঙ্গে রেহানার জবাব, 'ভাই, গত কয়েক মাস কোনো কিছুই ঠিকভাবে করতে পারিনি। বড় বেশি চাপে ছিলাম।'
ইদানীং আমার মনে হয় রেহানা একজন প্রকৃত মানুষ হয়েছে। মায়ের মতো মা হয়েছে। ওর কোনো কথায় কোনো ত্রুটি পাই না। বরং প্রতিটি কথায় আন্তরিকতায় ভরপুর পাই। প্রতিটি কথা হৃদয় ছুঁয়ে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় সবাই যদি অমন হতো তাহলে পৃথিবী না জানি কত শান্তিময় হতো। টিউলিপ রেজওয়ান সিদ্দিক, রুশনারা আলী ও রূপা আশা হককে অভিনন্দন জানানোর জন্য ভাবছিলাম। কারণ বাঙালি বংশোদ্ভূত তিন নারী যেভাবে ব্রিটিশ নির্বাচনে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে সেটা ভাবীকালের ইতিহাসের পাতায় অম্লান হয়ে থাকবে। আমি টিউলিপ রেজওয়ান সিদ্দিক, রুশনারা আলী ও রূপা আশা হকের সফল কর্মময় দীর্ঘ জীবন কামনা করি- আমিন।
লেখক : রাজনীতিক।