ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৩৬ ঘণ্টার বাংলাদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে গেছেন। বহুল আলোচিত এই সফর আয়তনে ছোট হলেও আকাশছোঁয়া গুরুত্বের চোখে দেখা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া বা অন্য কোনো অর্থনৈতিক-সামরিক শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর নিয়ে এত আনন্দ-উচ্ছ্বাস-উত্তেজনা সৃষ্টি হয়নি, যা নরেন্দ্র মোদির সফরকে কেন্দ্র করে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বের সঙ্গে সঙ্গে সরকার, সরকারি দল এবং সরকারবিরোধী বিএনপির এই সফর নিয়ে অতিমাত্রার উচ্ছ্বাস-আগ্রহ নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আগমনকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। শাসক লীগ এবং বিএনপির মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যেন একটা প্রতিযোগিতা লেগেছে। নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যকার 'প্রেম' গভীর তা প্রমাণেরও একটা হাস্যকর প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় দুই পক্ষের বক্তৃতা-বিবৃতিতে, বিশেষ করে বিভিন্ন টিভি টকশোতে তাদের 'দলদাস'দের ঘর্মাক্ত আলোচনায়। প্রথমেই শোনা গিয়েছিল যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় (!) নেত্রীর পাশাপাশি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেও দেখা করবেন, কথা বলবেন। সরকারি দলের লোকজন বলতে শুরু করল, না, খালেদা জিয়ার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির দেখা হবে না। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচি প্রণয়নে সে দেশের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বই যেন নিয়ে নিলেন কেউ কেউ। মনে হয়েছে এরা বুঝি দিল্লির সাউথ ব্লকের কর্মচারী। মাঝখানে শোনা গেল সত্যি সত্যিই মোদি-খালেদা বৈঠক হচ্ছে না। শাসক লীগের পক্ষে টকশো আলোচকদের, এমনকি কোনো কোনো উপস্থাপকের মুখে কী এক বিজয়ের (!) হাসি রাজনৈতিক অঙ্গনে চাউর হয়েছিল যে, লীগ সরকার চায়নি ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে কোনো বৈঠক করুক। সে জন্য তারা কূটনৈতিক চেষ্টাও চালিয়েছে বলে শোনা গেছে। অপরদিকে বিএনপির পক্ষ থেকেও ধরনা দেওয়া হয়েছে দিল্লির দরবারে। আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলেও মিডিয়ায় খবর এসেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী এবং বিপুলভাবে জনসমর্থিত একটি রাজনৈতিক দলের নেত্রীর সঙ্গে দেখা করলে ক্ষমতাসীন সরকারের কী ক্ষতি এবং তিনি সাক্ষাৎ না করলে বিএনপি কী হারিয়ে ফেলত এ ব্যাপারে মানুষের জানার আগ্রহ অবশ্যই থাকতে পারে।
এটা আমাদের দেশের সবারই ভালো জানার কথা যে, ভারতের প্রাচীন রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের সঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর ও দৃঢ়। আওয়ামী লীগের 'হাইব্রিড' নেতারা বলে থাকেন, এই সম্পর্ক আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল থেকে। কিন্তু তথ্যটি সত্য নয়। এ সম্পর্ক আরও আগের। পূর্বাপর সব উল্লেখ করতে গেলে লেখার কলেবর অনেক দীর্ঘ হবে। তাই এটুকু শুধু বলে রাখি যে, এই বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র'-এর এক সাবেক কর্মকর্তা অশোকা রায়নার 'ইনসাইড-র' গ্রন্থটি দয়া করে পড়বেন। মাসুদুল হকের 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে'র এবং সিআইএ গ্রন্থেও বিশদ বলা আছে এ ব্যাপারে। বইটির প্রকাশক ওসমানিয়া লাইব্রেরি, ৪২/৪৩/এ নর্থ ব্রুক হল রোড, ঢাকা। এ সম্পর্কের বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা গর্ব করতেন। কংগ্রেস এভাবে করুণভাবে শাসন ক্ষমতা হারাবে লীগ নেতারা হয়তো কস্মিনকালেও ভাবেননি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার জন্য প্রকাশ্যে ভূমিকা রেখেছে কংগ্রেস সরকার। লুকানো-ছাপানোর কিছু নেই। মন্ত্রী-সচিব পর্যায়ের লোকেরা বাংলাদেশ সফর করেছেন। তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং তো প্রকাশ্য তৎপরতাও চালিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪২টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিএনপিসহ ৩২টি দলই ওই নির্বাচন বর্জন করেছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। মনে হয়েছে মূলত তাকে বশ মানানোর জন্যই সুজাতা সিং বুঝি ঢাকায় এসেছিলেন। এরশাদ পরে সাংবাদিকদের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানিয়ে দেন, তিনি তাকে ওই নির্বাচনে অংশ নিতে বলেছেন। তিনি নাকি বলেছেন, 'শেখ হাসিনা যেভাবে বলেন সেভাবে নির্বাচনে যান।' প্রায় সব জাতীয় দৈনিকে এ বক্তব্য প্রকাশ হয়েছিল। সেই কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়েছে ভারতের বিগত লোকসভা নির্বাচনে। সংসদে বিরোধী দলের মর্যাদা পাওয়ার জন্য ৫৫টি আসনও পায়নি তারা। আওয়ামী লীগ তাতে হতাশ হয়েছিল বোঝা গেছে সেই নির্বাচন-পরবর্তী তাদের আবেগ-উচ্ছ্বাসহীন আচরণ থেকে, শোকাবহ একটা ভাব থেকে। অপরদিকে বিএনপিতে লক্ষ্য করা গেছে দৃষ্টিকটু উচ্ছ্বাস, উল্লাস। তাদের আচরণে মনে হয়েছে, সে দেশে বিজেপি নয়, যেন ভারতীয় বিএনপি জিতেছে। বিএনপির সঙ্গে ভারতের কোনো রাজনৈতিক দলের বন্ধুপ্রতিম সম্পর্ক কখনোই ছিল না। কংগ্রেসকে বলা হয়ে থাকে আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষক। কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সম্পর্ক-বন্ধুত্ব ছাড়াও কংগ্রেসের বাঙালি নেতা প্রণব মুখার্জি, সিদ্ধার্থ শংকর রায়, প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সীসহ অনেকের সঙ্গে আওয়ামী লীগের শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু এবং বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীসহ কারও কারও ব্যক্তিগত মধুর সম্পর্কও ছিল। তাদের পার্টি-টু-পার্টি রিলেশনটা বেশ পরীক্ষিত। কংগ্রেসের সঙ্গে মধুর সম্পর্কের কারণে বিজেপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্কটা তো তেতো হওয়াই স্বাভাবিক। যেহেতু বিজেপি এখন ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায়- ক্ষমতায় না থাকলে এক কথা, ক্ষমতায় থেকে ভারতের ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে বৈরী সম্পর্কের কথা কল্পনাই করতে পারে না আওয়ামী লীগ। কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নিবিড় সম্পর্কের কথা কি নরেন্দ্র মোদি জানেন না? বিষয়টি শেখ হাসিনাও বোঝেন। নিজেদের সম্পর্কে সন্দেহ দূর করা, বিশ্বাস (ট্রাস্ট) অর্জন করা আওয়ামী লীগের জন্য খুবই জরুরি। তাই নরেন্দ্র মোদির এ সফরকে তারা বিজেপি-আওয়ামী লীগ সম্পর্কোন্নয়নের একটা সুবর্ণ সুযোগ বলে ভাবতেই পারে। তাদের পক্ষে যারা লেখেন এবং বিভিন্ন টকশোতে কথা বলেন, তারা বিজেপি-আওয়ামী লীগ সম্পর্কের কথা বলেন না। তারা বলেন, ভারতের পররাষ্ট্রনীতির কথা, পূর্ববর্তী সরকারের সব কাজ ও গৃহীত পদক্ষেপের ধারাবাহিকতা রক্ষার কথা। এর মাধ্যমে তারা বোঝাতে চান যে, কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় থাকতে লীগ সরকারের সঙ্গে যে মধুরতম সম্পর্ক রেখেছিল, মোদি সরকারও তা রাখবে। বিএনপির সমালোচনা করে তারা বলেন, ওরা ভেবেছিল কংগ্রেসকে হারিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ কংগ্রেসের কাছ থেকে যে সহযোগিতা পেয়েছিল, এখন বিজেপি সরকারের কাছ থেকে বিএনপি সেই সহযোগিতা পাবে; ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ এবং জাতিসংঘসহ বাংলাদেশের অন্য উন্নয়ন সহযোগীরা যে চোখে দেখে এবং অংশগ্রহণমূলক একটি গ্রহণযোগ্য মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রশ্নে যেমন অটল, বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসায় ভারতও তার অবস্থান পাল্টাবে। তারা বিএনপির প্রতি উপহাস করে বলেন, তাদের সে আশা পূরণ হয়নি, হবে না। ভারতে যখন যে সরকারই আসুক না কেন, সম্পর্ক আওয়ামী লীগের সঙ্গেই থাকবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই সফরকালে যেসব চুক্তির কথা আলোচনা হচ্ছে তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষা হবে এসব আলোচনায় কানই দিতে চান না আওয়ামী লীগের পক্ষের আলোচকরা। তিস্তা চুক্তি এবারও হচ্ছে না বলা হচ্ছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ তো স্পষ্ট করেই তা বলে দিয়েছেন। তারপরও এ বিষয়ে আলোচনা তো হতেই পারে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও এসেছিলেন বাংলাদেশে। তার জন্যই হয়নি তিস্তা চুক্তি। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আসেননি। চলেও গেছেন আগে। এটা কেমন শিষ্টাচার! প্রধানমন্ত্রীর ভারতীয় লোকসভায় যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে তাতে রাজ্যের আপত্তি উপেক্ষা করে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সুসম্পর্কের প্রয়োজনে তিনি চুক্তিটি করেও ফেলতে পারেন। মমতা কি প্রধানমন্ত্রীকে সেই সুযোগ না দিয়ে কৃতিত্বটা নিজেই নিতে চান? তিস্তা চুক্তি নিয়ে নেতিবাচক সব মতামতের পরও তেমন একটা চমক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এ সফরকে কেন্দ্র করে দেখা যেতে পারে বলে অনেকেই ভাবছেন। অপরদিকে ভারতের কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিএনপির কোনো পার্টি-টু-পার্টি রিলেশন ছিল না। শুধু ভারত কেন, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকেও পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতার সঙ্গে বিএনপি তেমন কোনো সম্পর্ক গড়তে পারেনি। অথচ শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলে অনেক বিশ্ব নেতার সঙ্গে তার বন্ধুপ্রতিম সম্পর্ক ছিল, যা তার হত্যাকাণ্ডের পর দেখা গেছে। বিদেশে তার নামে সড়ক হয়েছে, গাছের নাম হয়েছে 'জিয়া ট্রি'। এবার বিজেপিকে তারা বন্ধু বানাতে চাচ্ছে বলে মনে হয়। কংগ্রেসের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক বৈরীই ছিল বলা চলে। ভারতে বিজেপি-কংগ্রেস সম্পর্ক রাজনৈতিক সাংগঠনিকভাবে সাপে-নেউলে। গত লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসকে একেবারে ধসিয়ে দিয়েছে বিজেপি। বিএনপির হিসাবটা বোধ হয় এমন যে, 'আমার শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু'। বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে তারা মরিয়া বলেই মনে হয়। শোনা যায়, ভারতের লোকসভা নির্বাচনের আগে থেকেই তারা দলটির নেতা নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। সেই উদ্যোগে লন্ডন থেকে তারেক রহমান কিছুটা সফলও হন বলে জানা যায়। নির্বাচনে জয়ের পর বিএনপি অভিনন্দন বার্তাও পাঠায়; ইতিপূর্বে ভারতের কোনো নতুন প্রধানমন্ত্রীকে এমন তাৎক্ষণিক অভিনন্দন জানানোর নজির নেই বিএনপির ইতিহাসে। এবার ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার সাক্ষাতের আয়োজন করার জন্য দলটির তৎপরতা লক্ষণীয়। এতে বোঝা যায়, বিএনপির ভারতনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু এটা স্থায়ী হবে কিনা সেই প্রশ্নও আছে। সবার মনে থাকার কথা যে, বেগম খালেদা জিয়ার সর্বশেষ ভারত সফরকালে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। রাখা হয়েছিল বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানকে যে হোটেলে রাখা হয় তেমন স্থানে। তিনি সেখানে ঘোষণা করেছিলেন, 'আমরা অতীত (ভারত সম্পর্কে) ভুলে যেতে চাই। পেছনে নয়, আমরা সামনে তাকাব। ভারতের জন্য ক্ষতিকর কোনো কাজে বাংলাদেশের ভূখণ্ড কাউকে ব্যবহার করতে দেব না' ইত্যাদি। দেশে-বিদেশে সবাই প্রশংসা করেছিল তার সেই ঘোষণার। তাতে স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল বিএনপি তার ভারতনীতিতে পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু তাতে বিএনপির অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল এবং জামায়াত-ঘনিষ্ঠদের বোধহয় বুক কেঁপে উঠেছিল। ওইদিন রাতেই তার সফরসঙ্গী এক কর্মচারী (সে দলের কোনো পর্যায়ের নেতা নয়, কখনো বিএনপি করেওনি) দিল্লিতেই মিডিয়ায় বিবৃতি দিয়ে দিলেন যে, 'বিএনপির ভারতনীতিতে কোনো পরিবর্তন হবে না।' সেই কর্মচারী এখনো আছেন। এখন নাকি আরও পাওয়ারফুল। দলের নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মী-সংগঠক, সাবেক মন্ত্রী, হুইপ, চিফ হুইপ, এমপিরাও নাকি বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কাছে তার সামনে নস্যি। ভারতীয়দের মনে কি প্রশ্ন জাগতে পারে না যে, বেগম খালেদা জিয়া ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে ভারতের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক বিন্যাসের যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তা আন্তরিক ছিল না।
ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশে তার সঙ্গে দেখা করার অফিসিয়াল প্রোগ্রাম রেখেছিলেন। হরতালের কথা বলে তিনি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। কেন, ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য ২-৩ ঘণ্টা বা একরাত হরতাল প্রত্যাহার করা যেত না? অনেকেই বলেন, দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের পরামর্শে তিনি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকে নয়, প্রকারান্তরে ভারত রাষ্ট্রকেই অবজ্ঞা করেছেন। এটা তার ভারতনীতির পরিবর্তন? এখন নরেন্দ্র মোদির এত 'প্রেম-ভিখারি' কেন বিএনপি? বিএনপির এই উপলব্ধি যদি সৎ ও আন্তরিক হয়, তা অবশ্যই মঙ্গলজনক। ভারতের সঙ্গে বৈরিতা করে বাংলাদেশের উন্নতি-অগ্রগতির চাকা সচল রাখা, গোটা অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার অপরিহার্য শর্ত পূরণ করা একেবারেই অসম্ভব। বাংলাদেশে ক্ষমতার রাজনীতিতে সফল হওয়া তো আরও অসম্ভব। বিএনপি এই লক্ষ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব নির্মাণের যে পরীক্ষা দিচ্ছে প্রতিপক্ষ তা নিয়ে উপহাস করলেও এই পরীক্ষার রাজনৈতিক মূল্য অপরিসীম। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য বিএনপিকে অভ্যন্তরীণ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে সম্পর্ক স্থাপনে আন্তরিকতার প্রমাণ দিতে হবে। এতদিন যারা এ কাজে বাগড়া দিয়েছে তাদের অফিস থেকে এবং দল থেকে বের করে দিতে হবে। উপর থেকে নিচে সর্বত্র প্রগতিশীল ও প্রকৃত জাতীয়তাবাদী গণতন্ত্রীদের হাতে নেতৃত্ব দিতে হবে। জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। মৌলবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়তে হবে। তবে ইসলামপ্রিয়তা ও মৌলবাদ নিশ্চয়ই সমার্থক নয়। নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য নির্লজ্জের মতো বিএনপি যা করছে তা একটু বেশিই মনে হচ্ছে। মনে হয় পাগল হয়ে গেছে। তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপির সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় বিএনপির প্রয়াসে লীগ মহলইবা এত বিচলিত কেন? বিএনপি-বিজেপি সম্পর্কে কি তারা তাদের সর্বনাশের বীজ দেখছে? এত ভয় কেন? কই তারা মোদি-খালেদা সাক্ষাৎ ঠেকাতে পারল কই? আজ তো তাদের দেখা হচ্ছেই। ভারতের সব দলের সঙ্গেই বাংলাদেশের সব দলের সম্পর্ক হোক না, তাতে ক্ষতি কী?
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
ই-মেইল : [email protected]