৭ জুন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন হয়ে থাকতে পারে। '৬৬-র ৭ জুন স্বাধিকার আন্দোলনে এদেশের মানুষ ফুঁসে উঠেছিল। '৬৯-এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান, '৭০-এর নির্বাচন, পরবর্তীতে স্বাধীনতার যুদ্ধ- সবই এক সুতোয় গাঁথা। এবার ৬ এবং ৭ জুন মহান প্রতিবেশী ভারতের সাড়া জাগানো নেতা ৩০ বছরের কোয়ালিশন সরকারের অবসান ঘটিয়ে একক দলীয় সরকার গঠনের প্রধান পথিকৃৎ নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদির বাংলাদেশ সফর ভাবীকাল কীভাবে মূল্যায়ন করবে সেটাই দেখার বিষয়। স্বাধীনতার পর ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে ভিভি গিরি প্রথম এসেছিলেন। আর বাঙালির অহঙ্কার বর্ষীয়ান জননেতা প্রণব মুখার্জি রাষ্ট্রপতি হিসেবে সর্বশেষ বাংলাদেশ সফর করেছেন। তার সফরে বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সে যাত্রায় সাক্ষাৎ না করে বাঙালির সৌজন্যের মহান ঐতিহ্যে কালিমা লেপন করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির বাংলাদেশ সফরের আগে বেগম খালেদা জিয়া ভারত সফরে গিয়েছিলেন। প্রণব মুখার্জির চেষ্টাতেই সে যাত্রায় রীতিনীতি ভেঙে তাকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয়েছিল। হায়দরাবাদ প্যালেসে রেখে বিশেষ বিমানে আজমীর, আগ্রা ঘুরানো হয়েছিল। খামখেয়ালি করে সে সম্মানের বদলা দিয়েছিলেন ভারতীয় রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সফরে এলে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে। সেই খামখেয়ালির বদলা পেতে বেশি সময় লাগেনি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরে তার সাক্ষাতের জন্য বেগম জিয়াকে অনেক খড়কুটো পুড়িয়ে সামান্য সময় নিতে হয়েছে। আমরা ছোট মানুষ, ২৮ জানুয়ারি থেকে দেশব্যাপী অবস্থান কর্মসূচিতে রাস্তায় রাস্তায় আছি। তারপরও দাওয়াত পেয়েছি। কর্মসূচিতে না থাকলে অবশ্যই যেতাম। কারণ আমার যৌবনের সোনার দিনগুলো ভারতে কাটিয়েছি। স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যের রক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। তাই ভারতীয় কোনো নেতাকে যথার্থ সম্মান জানাতে পারলে সব সময়ই ঋণ মুক্তি অনুভব করি। আল্লাহ যদি কখনো ভারত সফরের সুযোগ দেন নিশ্চয়ই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ভোটবঞ্চিত দেশবাসীর শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা জানিয়ে আসব।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় ভাটি বাংলায় পানিতে ভাসতে থাকায় কোনো পত্রপত্রিকা দেখতে পারিনি। গত পাঁচ মাস টিভির সঙ্গে দেখা নেই। তাই অনেক কিছুই দেখতে-শুনতে পাই না। তবু ভালোয় ভালোয় তার সফর শেষ হওয়ায় আল্লাহকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এত কিছুর পরও প্রকৃত বিরোধী দলের নেতা হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নরেন্দ্র মোদি রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন, তার জন্য তাকে প্রাণঢালা অভিনন্দন ও ধন্যবাদ। সংসদের বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদ হলেও এখনো সাধারণ মানুষের বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়া। যেভাবে নানা কলাকৌশল করে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির সাক্ষাৎ না হওয়ার চেষ্টা হচ্ছিল তাতে ভীষণ বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতো। বহু ভারতীয় নেতার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় থাকলেও নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ঠ ছিলাম না। তবু বলতে পারি তিনি যে ঝড়-তুফান তুলে দেশবাসীকে মাতিয়ে ভোটযুদ্ধে জয়ী হয়ে মহান ভারতের নেতৃত্ব নিয়েছেন তাতে তার যোগ্যতা দক্ষতা অহঙ্কার করার মতো না হয়ে পারে না। আগেই বলেছি, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর জন্য সবচেয়ে গৌরবের হবে যদি তিনি বাংলাদেশের প্রাণ খুঁজে পান। কোনো গোষ্ঠী, দল বা ব্যক্তির নয়। ভারতের সম্পর্ক হবে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মহান নেতাকে স্বাগত জানাতে আরও জনসম্পৃক্ততা করা যেত। জাতির অহঙ্কার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি। সেখানে অতিথিকে স্বাগত জানাতে আরও প্রবীণরা থাকতে পারতেন। বঙ্গভবনে প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে সারা জীবন বঙ্গবন্ধুকে গালি দেওয়া মতিয়া চৌধুরী অমনভাবে না ঘুমালেও পারতেন। কী এমন কাজ করেন যে অমন সম্মানী একজন বিদেশি মেহমানের সম্মানে আয়োজিত অনুষ্ঠানেও ঘুমাতে হবে? এতে আমাদের দেশের সম্মান বেড়েছে, না কমেছে? কী ধারণা হবে মহান অতিথির? আমাদের দেশের সিনিয়র মন্ত্রী বিদেশি মেহমানের সম্মানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এভাবে ঘুমায়?
অবস্থানের ১৩০তম দিনে কাকতালীয়ভাবে ভাসতে ভাসতে ভাটি বাংলার প্রাণকেন্দ্র ইটনায় গিয়েছিলাম- সে এক বিস্ময়কর ব্যাপার। ব্রিটিশ ভারতের ধ্যান-জ্ঞান-সাধনার প্রাণকেন্দ্র ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহ। ভাইসরের পিভি কাউন্সিলের সাত সদস্যের পাঁচজনই একসময় ছিল ময়মনসিংহের। জগদ্বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়, রবীন্দ্রসংগীতের প্রবাদপুরুষ জর্জ বিশ্বাস, কমিউনিস্ট নেতা মণি সিং, তৈলক্ষনাথ মহারাজ, নগেন সরকার, আনন্দমোহন বোস, গুরুদয়াল সরকার- কেউ কিশোরগঞ্জের, কেউ নেত্রকোনার, টাঙ্গাইল, শেরপুর, জামালপুর, কেউ ময়মনসিংহ সদরের। স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম পুরোধা, স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের যশোদলে। জয়সিদ্ধির স্যার আনন্দমোহন বোস, ধনপুরের কাঠইরের গুরুদয়াল সরকার, ঠিক তেমনি ইটনার একসময়ের প্রজাহিতৈষী জমিদার মহেষ গুপ্তের ছেলে কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ ভুপেশ গুপ্ত। আরও কতজন যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন ভাবা যায় না। মসনদ-ই-আলা ঈসা খাঁর জঙ্গলবাড়ি, বীরত্বগাথার ১১ সিন্ধু।
চামটাঘাট থেকে রওনার সময় ভেবেছিলাম, রাস্তায় কোথাও জুমার নামাজ আদায় করব। গত ৩-৪ বছর ২-১ ওয়াক্তের নামাজ ছুট গেলেও জুমার নামাজ বাদ পড়েনি। চলতে চলতে বেলা পৌনে ১টায় ট্রলারচালককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, 'আর কতদূর'? ছেলেটি বলেছিল, '১৫ মিনিট লাগবে।' কিন্তু ইটনা পৌঁছতে ৪০ মিনিট লেগে যায়। নামাজ পাব না মনে করে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ছুটে গিয়ে এক রাকাত ইমামের পিছনে, আরেক রাকাত একাই আদায় করি। নামাজে দাঁড়ানোর আগে যে বেদনা ছিল নামাজ পেয়ে তা অনেকটাই কেটে যায়। ২টা বেজে গিয়েছিল, তাই বেশ ক্ষুধা অনুভব করছিলাম। করিমগঞ্জের বহু পুরনো কর্মী আদম আলী ট্রলারে খাবার দিয়ে দিয়েছিল। প্রথম প্রথম উঠেছিলাম মুক্তিযোদ্ধা ছাত্রাবাসে। একেবারে পরিত্যক্ত অপরিষ্কার। তবু সেখানেই খেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কয়েক পা এগিয়েই দেখি উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ ভারতের রাজ্যসভার আজীবন সদস্য ভুপেশ চন্দ্রগুপ্তের বাড়ি। '৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কিছু দিন আগে ভুপেশ চন্দ্রগুপ্তের আত্মীয়স্বজন এক বিয়েতে কলকাতা গিয়েছিল। ঠিক সে সময় দুই দেশের যুদ্ধ বাধে। তারপর তাদের আর ইটনায় ফেরা হয়নি। হালের গরু, বাড়ির উঠানে ধান অনেক দিন পড়ে থাকে। সেই বাড়ি বহুদিন ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। ছেলেবেলায় শুনেছিলাম, 'মাগনা পেলে কেউ কেউ জুতার কালি খায়'। বিনাশ্রমে কোনো কিছু পেলে আমরা যে তা রেখে খেতে পারি না- সেটাই ভুপেশ চন্দ্রগুপ্তের বাড়ি বড় প্রমাণ। ৬০-৬৫ বছর যাবৎ বাড়িটি সরকারের হেফাজতে। রক্ষণাবেক্ষণ করলে এখনো ঝকঝকে তকতকে থাকত। ৪০ ইঞ্চি মোটা সীমানা প্রাচীর ধসে পড়ত না, ৩০ ইঞ্চির ভবনের দেয়ালগুলো খসে যেত না। সোনারগাঁ পানাম নগরীর যে দশা, এখানেও সেই একই অবস্থা।
শ্রী ভুপেশ চন্দ্রগুপ্ত ভারত উপমহাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক পথিকৃৎ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বিলেতে লেখাপড়া করতেন। দুজনের দারুণ সুন্দর সম্পর্ক ছিল। এখন মুক্তিযুদ্ধের কত ইতিহাস রচনা করা হয়, ডি.পি. ধর, পি.এন. হাঙার ছিলেন সরকারি কর্মচারী। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত দূত হিসেবে সারা দুনিয়া চষে বেড়িয়েছিলেন ভারতের দ্বিতীয় গান্ধী সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ। এখন কত নাম নিয়ে আলোচনা হয় কিন্তু শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ, শ্রী ভুপেশ চন্দ্রগুপ্তের নাম আসে না, আসে না যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর শান্তিময় রায়ের নাম।
ইটনার ভুপেশ চন্দ্রগুপ্ত এবং সরিষাবাড়ির শান্তিময় রায়কে স্বাধীনতার পরপরই চিনতাম। '৭২-এর জানুয়ারিতে শান্তিময় রায় আমার কাছে এসেছিলেন তার গ্রামের বাড়ি সরিষাবাড়ি যেতে। তাকে লোকজন, গাড়ি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়েছিলাম। এরপর শান্তিময় রায় যখন যেভাবে পেরেছেন আমাকে সাহায্য করেছেন। বঙ্গবন্ধু নিহত হলে আমার যখন ঠিকানা ছিল না, মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না, তখন তিনি তার যাদবপুরের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন। ঠিক তেমনি ভুপেশ গুপ্তও একজন মহান মানুষ। ইন্দিরা গান্ধী সরকারের পতনের পর আমার যখন চরম দুর্দিন, চারদিকে নিদারুণ অন্ধকার, অথৈই পানিতে যেন ভাসছি, কোনো কূলকিনারা পাচ্ছি না, তখন নেতাজী সুভাস বোসের ছায়াসঙ্গী ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা সমর গুহ এমপি এবং ইটনার জমিদার মহেশ গুপ্তের পুত্র ভুপেশ গুপ্ত রাজ্য এবং লোকসভায় একের পর এক প্রশ্নবাণে মোরারজি দেশাইর সরকারকে নাস্তানাবুদ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ সংগ্রামীদের যাতে জিয়াউর রহমানের হাতে তুলে দেওয়া না হয় তার জন্য লোকসভা এবং রাজ্যসভায় একের পর এক প্রস্তাব তুলেছিলেন। তারা দুজনই আমাকে অভয় দিতে বর্ধমান আসতেন। তাই ইটনার জরাজীর্ণ বাড়ির দক্ষিণে তাঁবু ফেলে রাত কাটানো এবং সেখানে বসে দুই কথা লিখতে গিয়ে পরোপকারী ভুপেশ দার কথা বারবার মনে পড়ছে। এই অঞ্চলে স্কুল-কলেজ-খেলার মাঠ যেখানে যা প্রয়োজন তার পূর্ব পুরুষরা করেছেন। ইটনার তার পৈতৃক বাড়ি সরকারি হেফাজতে থাকলে তাতে কোনো দোষ ছিল না। কিন্তু যদি যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ হতো, উপজেলা তহসিল অফিস বানিয়ে ধ্বংস করা না হতো- সেটা হতো সম্মানের। মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের একসময়ের নির্বাচনী এলাকা ইটনা। এমপি হিসেবে কিছু করতে পারেননি সেটা মেনে নেওয়া গেলেও রাষ্ট্রপতি হিসেবে কিছুই করতে পারবেন না সেটা মেনে নেওয়া যাবে না। অপেক্ষায় রইলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ ভূমিকা রাখা প্রাতঃস্মরণীয় এই মানুষটির পৈতৃক নিবাস আরও কিছুকাল সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি মহাকালের করাল গ্রাসে ধ্বংস হয়ে যাবে।
ইটনা আসার আগে ছিলাম করিমগঞ্জের বৌলাই। সে এক মর্মান্তিক হৃদয়বিদারক ঘটনা। আজ থেকে ১৫ বছর আগে ১৪ জুলাই করিমগঞ্জে এক জনসভার কথা ছিল। নতুন দল সবার মধ্যে নতুন উদ্দীপনা। অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান ভাটি বাংলার এক অবিসংবাদিত নেতা, মিঠামইনের অ্যাডভোকেট ফরিদ, কিশোরগঞ্জের হান্নান মোল্লা, ফারুক আহমেদ, অ্যাডভোকেট আজিজ আরও কতজন নতুন সম্ভাবনার স্বপ্ন নিয়ে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের গামছা ধরেছিল। কিশোরগঞ্জের শহীদি মসজিদে নামাজ আদায় করে অ্যাডভোকেট আজিজের বাড়ি খাবার খেয়ে করিমগঞ্জের পথ ধরেছিলাম। তখনকার দাপুটে নেতা করিমগঞ্জের হর্তাকর্তা বিধাতা অধ্যাপক মিজানুর রহমানের লোকজন বৌলাতে আমাদের বাধা দেয়। তারা স্লোগান তুলে, 'করিমগঞ্জের মাটি, মিজান স্যারের ঘাঁটি।' শুধু মিজান স্যারই করিমগঞ্জে থাকবেন, আর কেউ না। আসর, মাগরিব, এশার নামাজ আদায় করে সেখান থেকে ফিরেছিলাম। করিমগঞ্জের ওসি, ইউএনও, কিশোরগঞ্জের এডিসি আরও অনেক পুলিশ কর্মকর্তা তামাশা দেখতে গিয়েছিল। রাস্তায় বাধা দেওয়ার জন্য থানায় ডায়েরি করলেও তার কোনো প্রতিকার হয়নি। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, থানার ডায়েরিতে কাজ না হলেও আল্লাহর ডায়েরিতে কাজ হয়েছে। করিমগঞ্জ এখন আর মিজান স্যারের ঘাঁটি নেই, মিজান স্যারও নেই। দয়াময় আল্লাহ সেদিন যেমন দয়া করেছিলেন, আজও করছেন।
বছরটা মনে নেই, বৌলাই অবরোধের পর করিমগঞ্জ গিয়েছিলাম। কলেজ মাঠে মিটিং ছিল। সোহেল নামে ছোট এক বাচ্চা আকুল হয়ে কাঁদছিল। 'কী হয়েছে?' জিজ্ঞেস করতেই সে বলেছিল, ভৈরব রেলস্টেশনে মোবাইল কোর্ট তার বাবাকে ধরে জেলে পাঠিয়েছে। তখনই গাজীপুরের সভাপতি ইকবাল সিদ্দিকীকে বলেছিলাম, জেলে গিয়ে জরিমানা দিয়ে সোহেলের বাবাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে। রেল বিভাগের কাগজ জেলগেটে ছিল না। তাই সে রাতে সে বেরুতে পারেনি। কমলাপুর স্টেশনের লোকজন খুব সাহায্য করেছিল। পরদিন সকালে তারা স্পেশাল ম্যাসেঞ্জার দিয়ে কাগজপত্র গাজীপুর পাঠিয়েছিল। যে কারণে সে সকালেই জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরেছিল। এখন সোহেল বাবার সঙ্গে চায়ের দোকান করে। অপূর্ব সুন্দর সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এক যুবক। কিন্তু সেদিন তার দুই চোখের পানিতে বুক ভাসছিল। অনেক বছর পর বাপ-বেটাকে একসঙ্গে দেখে কী যে ভালো লাগল লিখে বুঝাতে পারব না। লিখলে অনেকেই কেমন ভাববেন জানি না, কিন্তু তবু ব্যাপারটি সত্য। '৭১-এর ১৮ ডিসেম্বর পল্টনে সভা করতে যাওয়ার পথে যখন তাদের বাড়ি গিয়েছিলাম তখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাও বাবার জন্য আকুল হয়ে কেঁদেছিলেন। কখন কে কাঁদে আর কে হাসে সবই সময়ের ব্যাপার। বীরউত্তম জিয়াউর রহমানের বাড়ি যখন যেতাম ভাবী খালেদা জিয়াও কত যত্ন করতেন। তিনিও প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এখন তো তারাই দেশের নেতা। কত কিছু দেখলাম, আল্লাহ কত কিছু দেখালেন। ভাটি বাংলার প্রাণকেন্দ্র ইটনায় ভুপেশ গুপ্তের বাড়ির আঙ্গিনায় তাঁবুতে বসে লিখতে গিয়ে কত কথা মনে পড়ছে। বিকালে একটি অনির্ধারিত মতবিনিময় সভায় তিল ধরার জায়গা ছিল না। এর আগে যতবার এসেছি, ফজলুর রহমানের সঙ্গে এসেছি। এবারই প্রথম আল্লাহর ভরসায় আবুল খায়েরের সঙ্গে অল্প বয়সী কিছু কর্মী নিয়ে এসেছি। শুনতে, জানতে, দেখতে এসেছিলাম হাওরে বাঁওড়ে যে শত শত গামছায় উড়ত তারা কি সবাই ফজলুর রহমানের সঙ্গে চলে গেছে, নাকি মানুষের গামছায় এখনো মানুষ আছে। বড় খুশি হয়েছি, ফজলুর রহমান গামছা ছেড়ে গেলেও ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রামের মানুষ তাদের গামছা তারা ছাড়েনি। ব্যাপারটা দেখে হৃদয় মন আনন্দে নেচে উঠেছে।
লেখক : রাজনীতিক।