বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে সম্প্রতি মোটরযান চুক্তি হয়েছে। ১৫ জুন ভুটানে স্বাক্ষরিত এ চুক্তিকে স্বাগত না জানানোর কোনো কারণ নেই। বলা হয়েছে ছয় মাসে চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে- বোঝা যাচ্ছে কাজ অনেক, সময় কম। চুক্তির ধারা-উপধারা নিয়ে তাই বিস্তর আলোচনা হওয়া জরুরি। মানুষের অধিকার আছে, 'চাহিবামাত্র তথ্য জানার'। ব্রিটিশ চলে গেছে সেই কবে, পাকিস্তানকে আমরা রক্তাক্ত-বিদায় জানিয়েছি তাও অনেক বছর, কিন্তু হায়, শাসকবর্গের মাইন্ডসেট বদলায়নি একটুও। স্বাধীন দেশের সরকার হয়েও শাসকশ্রেণি জনগণের থেকে তথ্য লুকানোর 'কলোনিয়াল হ্যাংওভার' বা 'ঔপনিবেশিক ঘোর' থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। মানুষকে অন্ধকারে রেখেই তারা ফুলবাড়ির কয়লার চেয়েও কালো চুক্তি করে এশিয়া এনার্জির সঙ্গে, আদিবাসীদের না জানিয়েই মধুপুরে ইকোপার্কের মাস্টারপ্ল্যান করে, হানা করে, সোফা করে। মুশকিল তাই হয়ে ওঠে তখন, তথ্যের একচ্ছত্র মালিকানা যখন থাকে কেবল সরকার, মন্ত্রী, আমলা, পুলিশের হাতে; মালিকানার তৈরি করা এই 'কৃত্রিম সিন্ডিকেটটি' ভাঙা দরকার। দরকার মালিকানায় পরিবর্তন আনা। রাষ্ট্রের মালিক কে? জনগণ। তথ্যের অবাধ মালিকানাও তাহলে জনগণের কাছে ন্যস্ত করতে হবে। তথ্য যাবে কৃষক শ্রমিক জনতার হাতে, তবেই রাষ্ট্রের মালিক যে জনগণ, সত্যিকার অর্থে সমাজে তখন এ বোধ তৈরি হবে। আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সঙ্গে সরকারগুলো কী শর্তে চুক্তি করে জানাতে হবে তাও।
চতুর্দেশীয় মোটরযান চুক্তিতে বলা হয়েছে, এর ফলে যাত্রী ও পণ্য চলাচল করতে পারবে। বন্দরের লাগসই ব্যবহার সিঙ্গাপুর ও শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এখান থেকে শিক্ষা ও দীক্ষা নিতে পারি আমরা। বিশ্বায়ন ও উদারীকরণের এই যুগে কানেকটিভিটি বা সংযুক্ততার কোনো বিকল্প নেই। ক'বছর আগে ইউরোপ গিয়েছিলাম- আমি টেরই পেলাম না কখন বাসে চড়ে বার্লিন থেকে পোল্যান্ডের ভিতরে ঢুকে পড়েছি; কিংবা জার্মানি থেকে অস্ট্রিয়া আর ইতালির সীমান্তে চলে এসেছি। কোনো চেকপোস্ট নেই, ভিসা-পাসপোর্টের বালাই নেই। জাস্ট টিকিট কেটে চলে যাচ্ছি এস্টোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া। একবার সেনজেন ভিসা পাওয়া মানে ইউরোপের ২৫টি দেশে ভ্রমণের গ্রিন সিগন্যাল হাতে পাওয়া। এশিয়া সেদিক থেকে অনেক পেছনে। তাই দক্ষিণ এশিয়া কিংবা বৃহত্তর অর্থে এশিয়া মহাদেশকেও দ্রুত ইউরোপের পথে হাঁটতে হবে। আটকে রাখা, বিচ্ছিন্ন থাকার সংস্কৃতি শেষ বিচারে মানুষকে বন্দী করে, মানুষের সম্ভাবনাকে ক্ষীণ করে এবং তার উৎপাদনশীলতাকে রুখে দেয়। পণ্য ও মানুষের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করা গেলে এতদঅঞ্চলে মাদক চোরাচালান, মানব পাচার, জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় একযোগে কাজ করার সুযোগ তৈরি হবে। কানেকটিভিটি বাড়ানো গেলে মানুষের কর্মসংস্থান, সেবাখাতের সুযোগ ও রপ্তানি-বাণিজ্যও বৃদ্ধি পাবে; উৎপাদনশীলতা বাড়াতে উন্নত ও সহজ যাতায়াত ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। আর মানুষে মানুষে যোগাযোগ বৃদ্ধি পেলে এক দেশের নাগরিক অন্য দেশ ও জাতির সংস্কৃতির প্রতি আরও সংবেদনশীল, আরও শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠবে; জাত্যাভিমান নয়, বরং সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের এই চর্চাই যে আখেরে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার হুমকি কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে- শাসকদের এ সত্য উপলব্ধি করতে হবে।
আন্তঃদেশীয় মোটরযান চুক্তিকে, আমার প্রতীতি, তাই দ্রুত বাস্তবায়নের পথে হাঁটতে হবে। কোন রুটে কীভাবে মোটরযান চলবে তা এখনো ঠিক হয়নি, এটি সুনির্দিষ্ট করতে হবে। বাংলাদেশের সড়ক আন্তর্জাতিক মানের নয়। অতিরিক্ত চাপে নূ্যব্জ আমাদের সড়কগুলো। এগুলোর মেরামত ও আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হবে। করতে হবে রাস্তা নির্মাণ ও সংস্কার, নতুন করে বেশ কিছু সেতু নির্মাণ করতে হবে, যান ট্র্যাকিং ব্যবস্থা, বন্দরের উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন ঘটাতে হবে। আইসিটি ইনস্টলেশন, ট্রানজিট ফি নির্ধারণ- এসবও করতে হবে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে। সবই সুনির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক হতে হবে। এর জন্য ৮ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রয়োজন। অবকাঠামো উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) সহায়তা দেবে। শুল্ক-মাশুল নির্ধারণে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখতে হবে, তবে প্রতিটি দেশের নিজস্ব হার ও আঞ্চলিক বাস্তবতাও বিবেচনায় রাখতে হবে। যেসব অশুল্ক বাধা রয়েছে তাও দূর করতে হবে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশের ট্যারিফ কমিশনকে আরও দক্ষ, আরও স্মার্ট করে গড়ে তুলতে হবে। ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ আর ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হওয়ার যে আত্দম্ভর আশা তা থেকে পিছিয়ে আসার সুযোগ নেই; আঞ্চলিক কানেকটিভিটি নিশ্চিত করা গেলে সে লক্ষ্য অর্জন আরও দ্রুত করা সম্ভব। চেষ্টা, সদিচ্ছা আর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ থাকলে সব অসম্ভবই যে সম্ভব তার প্রমাণ বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। সোনার সন্তানেরা পুরো পৃথিবী জয় করে চলেছে একের পর এক। তবে কোনো উদ্যোগই জনগণকে অন্ধকারে রেখে করা যাবে না। বিনিয়োগ, মাশুল নির্ধারণসহ খুঁটিনাটি সব ব্যাপারে জনগণকে অবহিত করতে হবে। পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সুফল কিংবা কী ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা নিয়েও স্টাডি হওয়া দরকার।
আর সংযুক্তি কেন শুধু সড়কপথে? রেলপথ নয় কেন? আকাশপথ, নৌপথ- এগুলোও বাদ যাবে কেন? পণ্য চলাচলের পাশাপাশি মানুষ, পানি, শ্রম, পুঁজি- সবার চলাচল অবাধ হওয়া জরুরি। কানেকটিভিটি হবে জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে। কেবল চার দেশ নয়, আরও সুদূরপিয়াসী হতে হবে। বিসিআইএম- বাংলাদেশ, ভারত, চীন, মিয়ানমারকে এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। চার দেশকে দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে আর দক্ষিণ এশিয়াকে পুরো ট্রান্স-এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক দরকার কিন্তু কেবল দ্বিপক্ষীয় আটকে থাকলে চলবে না। বহুপাক্ষিক ও বহুমাত্রিক আঞ্চলিক সম্পর্ক গড়তে হবে। কানেকটিভিটির এ আয়োজন অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল, ইউরোপ যেটা করে ফেলেছে বহু বছর আগে। আমরা পিছিয়ে আছি পশ্চাৎপদ মানসিকতা নিয়ে, নিরাপত্তার বাতিল ও পুরনো ধারণায় আটকে থেকে। ভিসা পাওয়া দারুণ কষ্টকর ব্যাপার- কানেকটিভিটি বললে ভিসা পদ্ধতি সহজ করতে হবে; গড়তে হবে ভিসামুক্ত দক্ষিণ এশিয়া। আজকের যুগের নিরাপত্তা মানে 'টেরিটরি' বা 'ভূখণ্ডগত' নিরাপত্তা নয়, আজকের নিরাপত্তার মূল কনসেপ্ট 'হিউম্যান সিকিউরিটি' বা 'মানব নিরাপত্তা'- মানবিক মর্যাদা, মানবাধিকার ও সম্মান নিয়ে তাবৎ মানুষের মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার আয়োজন যার মূল কথা।
শেষে প্রাসঙ্গিকভাবে এ প্রশ্নও আমাদের করতে হবে, কাঁটাতার আর কানেকটিভিটি একসঙ্গে চলে কিনা? কানেকটিভিটির কথা বলব, এ লক্ষ্যে চুক্তি করব আবার কাঁটাতারে ফেলানীর লাশ আটকে রাখব- তা কী করে হয়!!! চারদিক কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে ফেলে কানেকটিভিটির কথা বলা হাস্যকর বৈকি! দক্ষিণ আফ্রিকা দিয়ে ঘিরে থাকা রাষ্ট্র লেসোথোর কথা আমরা জানি, সে পথে আমরা হাঁটতে চাই না। আবার সড়ক, রেলের কানেকটিভিটির কথা বলব তাহলে কোন যুক্তিতে নদীর, পানির কানেকটিভিটির কথা বাদ দেব? এ অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য, অসাম্য, বৈষম্য ও নিপীড়নের যে বর্তমান অবস্থা নিঃসন্দেহে তা অমানবিক। আঞ্চলিক আধিপত্য, সংকীর্ণ করপোরেট স্বার্থ, বৈষম্যের দৃষ্টিভঙ্গি মানুষে মানুষে সত্যিকারের কানেকটিভিটির পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কানেকটিভিটির এসব অন্তনির্হিত স্ববিরোধিতা অতি অবশ্যই দূর করতে হবে। তাহলেই দক্ষিণ এশিয়ার জনমনে আস্থা তৈরি হবে। আর এভাবেই কানেকটিভিটির মতো তাৎপর্যপূর্ণ ও গভীর ধারণা-নিচয়টি 'পলিটিক্যাল রেটোরিক্স'-এ আটকে থাকবে না; 'রাজনৈতিক বাগাড়ম্বড়' থেকে বেরিয়ে এসে কানেকটিভিটি শব্দটি তখন তার সত্যিকার অর্থ খুঁজে পাবে। তাহলেই কেবল 'সংযুক্ত দক্ষিণ এশিয়া' গড়ে তোলা সম্ভব- যার মূল উপাদান সড়ক, রেলের সংযুক্তি নয়, মানুষের সঙ্গে মানুষের, হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের যোগ- যার মূল ভিত্তি হবে মানবাধিকার, সম্মান ও মানবিক মর্যাদা।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।