তুরু তুরু তুরু রু বাজি বাজেত্তে, পাড়ায় পাড়ায় বেরেবং বেক্কুন মিলিনে, এচ্চ্যা বিঝু, বিঝু, বিঝু- এর অর্থ হচ্ছে- তুরু তুরু তুরু রু বাঁশি বাজছে, পাড়ায় পাড়ায় বেড়াব সবাই মিলে, আজ বিঝু বিঝু বিঝু... এটা চাকমা সম্প্রদায়ের জনপ্রিয় বৈসাবি উৎসবের গান।
বছর ঘুরে আবারও এলো বৈসাবি। অর্থাৎ চাকমাদের বিজু, মারমাদের সাংগ্রাই, ত্রিপুরাদের বৈসুক আর তঞ্চঙ্গ্যাদের বিষু। জাতি ও ভাষাগত অমিল থাকায় ভিন্ন ভিন্ন নামে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা এ বৈসাবি উৎসব পালন করে থাকে। আর সবকিছুকে ছাপিয়ে এ উৎসবের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পুরোনো বছরকে বিদায়।
আর নতুন বছরকে বরণ করা। তাই বাংলা বছরের শেষ সময় আর এপ্রিল মাসের শুরু থেকে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ নাচ, গান আর নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে এই বৈসাবি উৎসব পালন করে থাকে। এরই মধ্যে পাহাড়ে ছড়িয়েছে বৈসাবি উৎসবের রং।
বৈসাবি : তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান। এসব জেলায় বাঙালির পাশাপাশি ১০ ভাষাভাষীর ১১টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বসবাস করে। এসব জাতি-গোষ্ঠীর যেমন আলাদা নাম-পরিচয় রয়েছে। তেমনি তাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির নাম ও উৎসবের রয়েছে ভিন্নতা। বর্ষবরণ আর বর্ষ বিদায়ের উৎসব বৈসাবি। চাকমারা বিজু, মারমারা সাংগ্রাই, ত্রিপুরা সম্প্রদায় বৈসুক, তঞ্চঙ্গ্যারা বিষু। এসব জাতি-গোষ্ঠীর উৎসবের নামের বঙ্গনাংশের অক্ষর দিয়ে পরিচয় লাভ করে বৈসাবি।
চাকমাদের বিজু : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম বৃহত্তর সম্প্রদায় চাকমা। জনগোষ্ঠী বেশি তাই আচার-অনুষ্ঠানের পরিধিও বেশি। বৈসাবিকে চাকমারা বিজু নামে পালন করে। আর বিজুকেও তিন ভাগে ভাগ করে তিন দিন পর্যন্ত উৎসবে মেতে থাকে চাকমা জনগোষ্ঠী। বিজুর মধ্যে রয়েছে ফুল বিজু অর্থাৎ বছরের শেষ দিন। পুরোনো বছরের সমস্ত গ্লানি ধুয়ে মুছে ফেলতে কাপ্তাই হ্রদে স্নান করে গঙ্গাদেবীকে ফুলপূজা করে চাকমা জনগোষ্ঠী। এ সময় সূর্য দেবতাকে প্রার্থনা করে পুরোনো বছরের অশুভ শক্তি থেকে মুক্তি পেতে। যাতে নতুন বছরটা সুন্দরভাবে কাটাতে পারে। পর দিন অর্থাৎ এপ্রিলের ১৩ তারিখ পালন করা হয় মূল বিজু। নতুন জামাকাপড় পরে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ানো আর নাচ-গানের আসরের মধ্যে দিয়ে পার করে দিনটি। আর ১৪ এপ্রিল গজ্জ্যাপজ্জ্যা অর্থাৎ বাংলা নববর্ষ। বছরের প্রথম দিন এসব জনগোষ্ঠী কোনো কাজ করে না। সারা দিন পরিবার-পরিজনকে সময় দেয় আর আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়।
মারমাদের সাংগ্রাই : মারমা ও রাখাইন জনগোষ্ঠী বৈসাবিকে সাংগ্রাই অর্থাৎ জলকেলির মধ্য দিয়ে পার করে। এসব জাতি-গোষ্ঠী মনে করে জল হচ্ছে পবিত্র। তাই নতুন বছরকে বরণ আর পুরোনো বছরকে বিদায় জানাতে তারা জলোৎসব অর্থাৎ সাংগ্রাইয়ের উৎসব আয়োজন করে। মারমা ও রাখাইন নারী পুরুষ তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে মাঠে প্যান্ডেল তৈরি করে জলোৎসবের আয়োজন করে। মারমা তরুণ-তরুণীরা একে অন্যকে পানি ছিটিয়ে নিজের ভালোবাসার ভাব প্রকাশ করে। সাংগ্রাই উৎসব পালন করতে সারা দিন নাচ-গান আর জলকেলিতে মাতোয়ারা থাকে এসব জনগোষ্ঠী।
ত্রিপুরাদের বৈসুক : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে চাকমাদের পর ত্রিপুরা আরও একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী। তারাও বৈসাবিকে নানাভাবে পালন করে। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুকে তিন ভাগে ভাগ করে উৎসব পালন করে থাকে। হারি বিজু অর্থাৎ ফুল বিজু। বছরের শেষদিন খুব ভোরে আকাশে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কাপ্তাই হ্রদের পাড়ে ফুলপূজা করে তা গঙ্গাদেবীকে উৎসর্গ করে ত্রিপুরা। এর বৃদ্ধাস্নানের মধ্য দিয়ে বয়োজ্যেষ্ঠদের আশীর্বাদ গ্রহণ করে। এ সময় তাদের নতুন বস্ত্রদান করে ত্রিপুরারা। এরপর দিন পালন করে বিষুমা মানে মূলবিজু। এদিন তারা ৩২ প্রকার সবজি দিয়ে পাজন রান্না করে। আর আনন্দ উৎসব করে। এরপর বাংলা নববর্ষ মানে নতুন বছরে তারা বিষু কাতান নামে নতুন বছরের উৎসব পালন করে।
তঞ্চঙ্গ্যাদের বিষু : তঞ্চঙ্গ্যারা বৈসাবিকে বিষু নামে পালন করে। তাদেরও থাকে তিন দিনের উৎসব। তারাও ফুল বিজুতে পূজার পর নদীতে ফুল ভাসায়। মূল বিজুতে নাচ-গানের আসর বসায়। আর ঘুরে বেড়ায় বাংলা নববর্ষের দিন।