দরিদ্রতাকে জয় করে কঠিন জীবনসংগ্রামের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছিলেন সারা দেশের অনেক শিক্ষার্থী। দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা এই শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার খরচ কিভাবে চালাবেন, তা নিয়ে তাঁরা যখন চিন্তায় চিন্তায় দিশাহারা, তখনই পাশে দাঁড়ায় বসুন্ধরা শুভসংঘ। দেশের অনেক সংবাদমাধ্যমে তাঁদের সংবাদ প্রচারিত হয়। সেই সংবাদগুলো দেখে দিশাহারা এই শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেন বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান।
বসুন্ধরা শুভসংঘের প্রধান ও নন্দিত কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বসুন্ধরা শুভসংঘ টিম। বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে প্রতি মাসে পড়ার খরচ দেওয়া হচ্ছে তাঁদের। মাসের শুরুতেই টাকা পেয়ে এখন নিশ্চিন্তে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা। বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে প্রতি মাসে টাকা পাওয়া সেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছেন আমাদের প্রতিনিধি।
তাঁর পাঠানো তথ্য ও ছবিতে এবারের আয়োজনটি সম্পাদনা করেছেন জাকারিয়া জামান-
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির টাকাও দিয়েছে বসুন্ধরা
শতাব্দী রায়
ইংরেজি বিভাগ
আমি শতাব্দী রায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। নিম্নবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। ছোট থেকেই খুব কষ্ট করে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে পড়াশোনা করছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে আমি ও আমার পরিবার যতটা খুশি হয়েছিলাম, কিভাবে ভর্তি হব, এত টাকা কোথায় পাব, সেটা নিয়ে ততটাই দুশ্চিন্তায় ছিলাম। আমাদের তিন সদস্যের পরিবারে বাবা একমাত্র উপার্জনকারী। তিনি মাসে আয় করেন মাত্র ছয় হাজার টাকা। এই টাকায় পরিবার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছেন সেখানে আমার পড়াশোনার খরচ বহন করা বিলাসিতার মতোই। ভেবেছিলাম আর পড়া হবে না।
পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েও পড়তে পারব না ভেবে খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। তখনই দেবদূতের মতো সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় বসুন্ধরা গ্রুপ। বসুন্ধরা শুভসংঘের মাধ্যমে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারি। ভর্তি-পরবর্তী সময়ে প্রতি মাসে আমার একাডেমিক খরচসহ মাসিক হাতখরচের টাকা জোগান দিচ্ছে বসুন্ধরা গ্রুপ। যদি স্কলারশিপটা না পেতাম, তাহলে অনেক চিন্তার মধ্যে থাকতে হতো কিভাবে শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করব এটা নিয়ে। এখন স্কলারশিপটা পেয়ে চিন্তামুক্তভাবে নির্বিঘ্নে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছি। আমি বসুন্ধরা গ্রুপ শুভসংঘের কাছে কৃতজ্ঞ। যদি কোনো কারণে স্কলারশিপটা কখনো বন্ধ হয়, তাহলে আমার পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ আমার পরিবারের পক্ষে পড়াশোনার খরচ বহন করা সম্ভব নয়।
মায়ের দেওয়া টাকায় খাওয়ার খরচও হতো না
তানিয়া ইসলাম
ইংরেজি বিভাগ
আমি তানিয়া ইসলাম। এবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। মা ও আমি এই দুজনই আমাদের পরিবার। বাবা মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। উপার্জনের কেউই নেই আমাদের পরিবারে। অনেক কষ্টে মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছিলাম। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়েই হন্য হয়ে টিউশনি খুঁজতেছিলাম। কিন্তু নতুন হিসেবে কোনো টিউশনি পাচ্ছিলাম না। প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছিল পড়াশোনার খরচ চালানো। বাড়ি থেকে অনেক কষ্ট করে মা যে সামান্য টাকা দিতেন, তাতে খাওয়ার খরচই হতো না। হলের রুমে বসে শুধু ভাবতাম, মা গৃহিণী। বাবা হঠাৎ শ্বাসক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। পরিবারে উপার্জন করার মতো কেউ নেই। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে এলাম পড়াশোনার খরচ বহন করা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ল। এখন আমি কী করব? দিশাহারা আমাকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখায় বসুন্ধরা শুভসংঘ। বসুন্ধরা গ্রুপের স্কলারশিপটি আমাকে আশার আলো দেখায়। বর্তমানে এই স্কলারশিপটি আমার পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম। আমার খাওয়ার খরচ এবং পড়াশোনার আনুষঙ্গিক সব খরচ এই স্কলারশিপের মাধ্যমে চালাতে পারছি। যদি কখনো এটি বন্ধ হয়ে যায়, আর্থিক এবং মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে আমাকে। প্রতিদিনই প্রার্থনা করি, যেন বসুন্ধরার এই সহযোগিতা অব্যাহত থাকে। আমার মতো হাজারো শিক্ষার্থী যেন বসুন্ধরা শুভসংঘের মাধ্যমে তাদের স্বপ্নপূরণে সফল হয়।
অনেক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন এই বৃত্তি পেয়ে
সারওয়াত হোসেন বুশরা
ইতিহাস বিভাগ
আমি সারওয়াত হোসেন বুশরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী। জন্মের পর থেকেই এক চোখে দেখতাম। আরেক চোখে দেখতাম না। বয়স যখন চার বছর হলো ‘অপটিক নার্ভ’ শুকিয়ে গেল। দুই চোখের আলো নিভে যায় তখন থেকেই। চার বছর বয়স থেকে আমি আর চোখে দেখি না। এই প্রতিকূলতাকে জয় করে লেখাপড়া চালিয়ে গিয়েছি। ভর্তি হয়েছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। আমার বাবা বেকার আর মা গৃহিণী। আমি তো চোখে দেখি না। পারিবারিক অবস্থা খুবই করুণ। বাবার একটি ব্যবসা ছিল। কভিডের সময় এবং পরবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে যে আর্থিক অভাব-অনটন দেখা দিয়েছিল, সেই অভাব-অনটন আমাদের পরিবারেও থাবা দেয়। কোটি কোটি মানুষ তখন বেকার হয়ে যায়, অনেকে নিঃস্ব হয়। আমার বাবাও ছিলেন তাদের মতো একজন অভাগা। ওই সময় তাঁর ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। অতীতের পুঁজি দিয়েই কিছুদিন সংসার চলেছে। বড় বোন একটি প্রাইভেট স্কুলে চাকরি করেন। বর্তমানে তা দিয়ে চলে আমাদের সংসার। তাঁর পক্ষে তো সংসার চালিয়ে পড়াশোনার খরচ দেওয়া সম্ভব না। কিভাবে পড়াশোনার খরচ চালাব, তা নিয়ে যখন চিন্তা করছি, তখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বসুন্ধরা শুভসংঘ। তারা পাশে দাঁড়িয়েছে বলেই পড়াশোনার খরচ চালাতে পারছি। পারছি পড়াশোনা করতে, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখতে। এ জন্য আমি বসুন্ধরা শুভসংঘের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। আমার মতো দৃষ্টিহীন ছাত্রীর উচ্চশিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়া অত্যন্ত দুরূহ কাজ। বসুন্ধরার বৃত্তির সহযোগিতায় চলতে হয় আমাকে। শিক্ষাক্ষেত্রে বা চলাফেরার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের খরচ সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের চেয়ে বেশি। কারণ হিসেবে একাধিক বিষয়কে চিহ্নিত করা যেতে পারে। যেমন আমাকে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাতায়াতের ক্ষেত্রে পরিবহনের সাহায্য নিতে হয়। এ ছাড়া পড়াশোনার ক্ষেত্রে একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীকে একজন রিডার নিযুক্ত করতে হয়। এর পাশাপাশি পরীক্ষা চলাকালে শ্রুতি লেখকের সহায়তায় পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। এই সমস্ত বিষয়ে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। ফলে যদি কোনো কারণে বসুন্ধরার এই বৃত্তি বন্ধ হয়ে যায়, তবে এককথায় এটিই হবে আমার শিক্ষার পথে বিরাট প্রাচীর। শিক্ষাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আমার উচ্চশিক্ষিত হওয়ার স্বপ্নের অকালমৃত্যু মেনে নিতে হবে। আমার মতো অনেক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী বসুন্ধরা গ্রুপের সহায়তা নিয়ে পড়াশোনা করছে। স্বপ্নপূরণে আপনাদের এই সহযোগিতা আমাদের আজীবন ঋণী করে রাখবে। পাশে থেকে এই অসহায় শিক্ষার্থীদের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নে আপনাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকুক।
আমার আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করেছে বসুন্ধরা
মো. বখতিয়ার উদ্দিন
আইন ও বিচার বিভাগ
অনেক কষ্টে এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছিলাম। বহু সংগ্রাম ও ত্যাগ-তিতিক্ষার পর অর্জন করেছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের একটি আসন। সাত সদস্যের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আমি। পরিবারে একমাত্র উপার্জন করেন আমার বড় ভাই। তাঁর আয়েই চলে পুরো পরিবারের খরচ। সবার খাবার আর চিকিৎসার খরচ চালিয়ে পরিবারের অন্য কোনো খরচ চালানো ভাইয়ের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধার-দেনা করে কোনোভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। এরপর ভেবেছি টিউশনি করেই পড়ালেখা চালাতে পারব, কিন্তু যা ভেবেছিলাম তার কোনো কিছুই হয়নি। মফস্বল থেকে উঠে এসে শহরে টিকে থাকার মতো সামর্থ্য হচ্ছিল না। টিউশনি করে টিকে থাকার চেষ্টা করতে থাকা আমি এবং খড়কুটো ধরে সমুদ্রে ডুবন্তপ্রায় সাঁতার না জানা ব্যক্তির গল্প প্রায় একই সূত্রে গাঁথা। ঢাকা থেকে দূরে ক্যাম্পাস হওয়ায় এখানে ভালো টিউশনি নেই। যতটুকু টিউশনি পাওয়া যায়, সেটিও প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী হওয়ায় আমাকে অনভিজ্ঞ বিবেচনা করে বাতিল করা হয়। এই অবস্থায় ত্রাতা হয়ে আসে বসুন্ধরা গ্রুপের স্কলারশিপ। বসুন্ধরা শুভসংঘের মাধ্যমে শিক্ষাবৃত্তি পাওয়ার পর নিজের ভেতরে আত্মবিশ্বাস জাগ্রত হয়। তখনই মনে হয়, এখান থেকে পড়ালেখার খরচ এবং খাওয়ার খরচ চালাতে পারব। আমার শিক্ষাজীবনটি সুন্দরভাবে চালাতে পারব। তার পর থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে পড়ালেখা করে যাচ্ছি। সামনেই পরীক্ষা। আশা করি, খুব ভালো ফল করব। এই স্কলারশিপটি কখনো বন্ধ হয়ে গেলে ক্যাম্পাসে থেকে পড়ালেখার খরচ এবং খাওয়াদাওয়ার সর্বনিম্ন খরচের ব্যবস্থা করাও কঠিন হয়ে পড়বে আমার জন্য। হয়তো শিক্ষাজীবনের ইতিও টানতে হবে।
অনেক কৃতজ্ঞ বসুন্ধরা গ্রুপের প্রতি
আখি আক্তার
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ
আমি আখি আক্তার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। পড়াশোনা করেছি মাদারীপুর সরকারি কলেজে। এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছিলাম। আমাদের চার সদস্যের নিম্নবিত্ত পরিবারে বাবাই একমাত্র উপার্জনকারী। একটি বেসরকারি অফিসে গাড়ি চালান আমার বাবা। তাঁর টাকায়ই চলে আমাদের সংসার। নিজে না খেয়ে আমাদের ভালো খাইয়ে পড়াশোনার খরচ চালিয়েছেন বাবা। তিনি চাইতেন আমি একটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। আল্লাহ আমার বাবার চাওয়া পূরণ করেছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই দিনে বাবার পক্ষে আমার পড়াশোনার খরচ চালানো খুবই কষ্ট হচ্ছিল। বিষয়টি বসুন্ধরা শুভসংঘ অফিসে জানানো হয়েছিল। তারা সব কিছু খোঁজখবর নিয়ে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পুরো খরচ দিয়েছে এবং প্রতি মাসে আমাকে পড়াশোনার খরচ দিচ্ছে। পড়াশোনার খরচ চালাতে যখন আমার বাবা হিমশিম খাচ্ছিলেন, তখন আমার পাশে দাঁড়িয়েছে বসুন্ধরা শুভসংঘ। বসুন্ধরা গ্রুপের মাধ্যমে তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে, যার কারণে এখনো পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছি। পড়াশোনার ক্ষেত্রে আমাকে স্কলারশিপ দিয়ে আর্থিকভাবে সহযোগিতার জন্য অনেক কৃতজ্ঞ বসুন্ধরা গ্রুপের প্রতি। এই স্কলারশিপ না থাকলে আমি হয়তো পড়াশোনা করতে পারতাম না।
এতিমখানায় থেকে এইচএসসি পাস করেছি
মো. মহসিন আলি
বাংলা বিভাগ
‘আমি মো. মহসিন আলি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারব কিংবা এত দূর আসতে পারব, আমি কল্পনাই করতে পারিনি। আমার এই পথচলাকে সহজ করে দিয়েছে বসুন্ধরা শুভসংঘ। আমার বয়স যখন আট বছর, বাবা লিভার সিরোসিসে মৃত্যুবরণ করেন। জীবিত থাকাকালেও বাবা খুবই অসুস্থ ছিলেন। কোনো কাজ করতে পারতেন না। মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে সংসার চালিয়েছেন মা। বড় দুই ভাই বিয়ে করে আলাদা সংসার করছেন। আমাদের কোনো খোঁজ রাখেন না। বাবা মারা যাওয়ার পর মা গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষের বাড়িতে রুটি বিক্রি ও গৃহকর্মীর কাজ শুরু করেন। মায়ের কষ্টার্জিত এই স্বল্প উপার্জনে চলতে থাকে দৈনন্দিন জীবন। শত অভাব-অনটনের মাঝেও মা আমার পড়ালেখা চালিয়ে নিয়েছেন। মায়ের ইচ্ছা ছিল, আমি উচ্চশিক্ষিত হব। আমিও স্বপ্ন দেখেছি উচ্চশিক্ষা অর্জন করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে মায়ের কষ্ট দূর করব। বহু মানুষের সহযোগিতা নিয়ে টিউশনি করে আমি পড়ালেখা চালাতে থাকি। এভাবেই আমার এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়া হয়। দুটি পরীক্ষায়ই আমি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হই। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে এইচএসসি পর্যন্ত আমি এতিমখানায় কাটিয়েছি। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধের পালা। এলাকার পরিচিত ভাইয়ের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ে বিনা মূল্যে ক্লাস করার সুযোগ পাই এবং তাঁর পুরনো বইগুলো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিই। কোনো অভিভাবক না থাকায় আমার চলার পথ ছিল খুবই কঠিন। দৃঢ় প্রচেষ্টার ফলে অনেক কষ্ট, অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বিইউপিসহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাই। অনেক কিছু বিবেচনা করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হব বলে মনস্থির করি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং ভর্তি-পরবর্তী যাবতীয় খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই। পড়ালেখা চালানোর কোনো উপায় আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কিভাবে ভর্তি হব, কিভাবে টাকা জোগাড় করব—এসব ভাবতে ভাবতে মনে হচ্ছিল চিন্তায় মরে যাব। একটি মাধ্যমে আমি বসুন্ধরা শুভসংঘে যোগাযোগ করি। সব সমস্যার কথা শোনেন ইমদাদুল হক মিলন স্যার। বসুন্ধরা শুভসংঘের মাধ্যমে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিসহ পড়ালেখার সব দায়িত্ব নেয় বসুন্ধরা গ্রুপ। বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান স্যারের সহযোগিতায় আজ আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আমার স্বপ্ন পূরণ করেছে বসুন্ধরা গ্রুপ। আমি সব সময় দোয়া করি, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান স্যার ও তাঁর পরিবারের সবাই দীর্ঘজীবী হোন। বসুন্ধরা শুভসংঘের প্রতি আমি অনেক অনেক কৃতজ্ঞ, আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তে তারা পাশে দাঁড়িয়েছে।
দাদিকে প্রতি মাসে টাকা দিই
রাব্বি হোসাইন জীবন
আইন ও বিচার বিভাগ
রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছিলাম। এই পর্যন্ত যে পড়তে পারব, তা-ই চিন্তা করিনি কখনো। তারপর অনেকের সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিং করি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ও বিচার বিভাগে ভর্তির জন্য মনোনীত হই। এবার ভর্তির পালা। এখানেও অনেক মানুষের সহযোগিতার হাত। ভর্তি হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি। ভেবেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হলেই টিউশনি পাওয়া খুব সহজ। কিন্তু আমার ধারণা পুরো ভুল ছিল। টিউশনি পাচ্ছিলাম না কিছুতেই। বাবা ভাঙ্গারি বিক্রয় করেন। পদ্মার ভাঙনে ভিটাবাড়ির ক্ষতি এবং বোনের বিয়েসংক্রান্ত কারণে এনজিও থেকে অনেক টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছিল। এগুলোর কিস্তি এখনো শেষ হয়নি। কিস্তি দেওয়ার পাশাপাশি বাড়ির খরচই ঠিকমতো দিতে পারেন না বাবা। সেখানে আমার পড়ালেখার খরচ তো অনেক দূর। কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। শুধু ভাবছিলাম পড়ালেখার বোধ হয় ইতি টানতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধুর মাধ্যমে বসুন্ধরা শুভসংঘের বৃত্তির জন্য আবেদন করি, যেটি আমার জন্য একটি লটারি বিজয়ের মতো হয়। তখন বসুন্ধরা গ্রুপের সহায়তা না পেলে পড়াশোনাই করা হতো না। বর্তমানে হলের পেছনেই গেরুয়াতে একটি টিউশনি করি। তিন হাজার টাকা পাই। আর বসুন্ধরা শুভসংঘের বৃত্তি তো আছেই। একটি টিউশনি ও বৃত্তির টাকা থেকে নিজে চলা ও একটি সাইকেল কেনার জন্য টাকা জমানোর পাশাপাশি আমার দাদিকে মাসে ৫০০ টাকা দিই। দাদা মারা গেছেন গত বছরের ডিসেম্বরে। আব্বা বর্তমানে ফ্যামিলিতেই তেমন দিতে পারেন না। তাই দাদিকে আমি টাকা দিই। পাশাপাশি দাদি কলাইয়ের ডাল ভেজে বিক্রি ও শাক-সবজি আবাদের মাধ্যমে চালিয়ে নেন নিজেকে। বসুন্ধরা শুভসংঘের বৃত্তি আমার কাছে পড়াশোনার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করতে পারব
মোছা. বিথী আক্তার
সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
বসুন্ধরা শুভসংঘ স্কলারশিপ আমার পথচলা অনেক সহজ করে দিয়েছে। বাবা মারা গেছেন ২০১৮ সালে। তার পর থেকে মা অনেক কষ্ট করে আমার পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। কিন্তু একটা সময় মনে হয়েছিল হয়তো বা অর্থনৈতিক অভাবের ফলে পড়াশোনা আর চালিয়ে নিতে পারব না। আমার স্বপ্ন এখানেই শেষ হয়ে যাবে। ঠিক এই সময়েই মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ মেহেরবানিতে বসুন্ধরা শুভসংঘের সান্নিধ্য পেলাম। তার পর থেকে আলহামদুলিল্লাহ আমার পড়াশোনা ঠিকভাবে চালিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছি। বর্তমানে আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার ও রাজনীতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আমাদের চার সদস্যের পরিবারে আয়ের মানুষ আসলে নেই। মা কী যে কষ্ট করেন বলে বোঝাতে পারব না। মায়ের সাপোর্টেই এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছি। অনেকের সহযোগিতায় ও মায়ের অনুপ্রেরণায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার ও রাজনীতি বিভাগে চান্স পেয়েছি। প্রথম বর্ষে ভালো ফল করেছি। আমার সিজিপিএ ৩.৬২। অর্থনৈতিক কারণে আসলে আমার পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে গিয়েছিল। তখনই আমি শুভসংঘের মাধ্যমে বসুন্ধরা গ্রুপের সহায়তাটা পাওয়া শুরু করি। এখন আর চিন্তা নেই। বসুন্ধরা গ্রুপ পাশে থাকলে নিশ্চিন্তে ভালো ফল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করতে পারব, ইনশাআল্লাহ। আমার স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করতে পারব। যেহেতু আমার বাবা নেই, কোনো কারণে যদি স্কলারশিপটা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে আমার পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে। সব স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে। বসুন্ধরা স্কলারশিপের ওপর নির্ভর করেই আমার পথচলা।