বর্ষবরণ উপলক্ষে পাহাড়ে শুরু হয়েছে নানা উৎসব। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা—বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে বসবাসরত ১১টি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিজু, সাংগ্রাইং, বৈসু, বিষু অন্যতম বৃহৎ সামাজিক উৎসব।
এসব উৎসবে মেতেছে উঠেছে পাহাড়ি জনপদের বাসিন্দারা। উয়ই সিং মার্মা, রবিন তঞ্চঙ্গ্যা, উ অং সিং মার্মা মৈত্রীময় চাকমা, পুলক চাকমা, স্বর্ণা চকমা, সিদ্ধাঙ্গনা চাকমাসহ বসুন্ধরা শুভসংঘের বন্ধুরা মেতে ওঠেন উৎসব আনন্দে।
উয়ই সিং মার্মা, রবিন তঞ্চঙ্গ্যা, উ অং সিং মার্মা মৈত্রীময় চাকমা, পুলক চাকমা, স্বর্ণা চকমা, সিদ্ধাঙ্গনা চাকমা সহ বসুন্ধরা শুভসংঘের বন্ধুরা মেতে উঠেন উৎসব আনন্দে। শনিবার (১২ এপ্রিল) সম্প্রীতির মেলবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন বসুন্ধরা শুভসংঘ বান্দরবান জেলা শাখার বন্ধুরা।
ফুল দিয়ে জলবুদ্ধ ও মা গঙ্গাদেবীর উদ্দেশে পূজা ও ক্ষমা প্রার্থনার মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম বৃহৎ সামাজিক উৎসব বিজু-সাংগ্রাই-বৈসু-বিষু-এর সূচনা হয়েছে।
নদীর তীরে ঐতিহ্যবাহী ফুলবিজু পালন করেন চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের লোকজন। ভোর থেকেই নারী, পুরুষ ও শিশুরা রঙিন ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে, কলাপাতায় সাজানো ফুল নিয়ে নদীর তীরে সমবেত হন।
মোমবাতি জ্বালিয়ে ও ফুল অর্পণের মাধ্যমে অতীতের সব ভুলভ্রান্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন তারা। প্রার্থনায় উঠে আসে শান্তি, সমৃদ্ধি ও ভবিষ্যতের সুন্দর জীবনের আকাঙ্ক্ষা।
ভোরে ফুল সংগ্রহ করে নদীতে গিয়ে ফুল নিবেদন করেছেন স্বর্ণা চাকমা। অতীতের ভুল মুছে গিয়ে আগামীর দিনগুলো মঙ্গলময় হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
মনের অভিব্যক্তি তুলে ধরে পুলক চাকমা বলেন, ‘আমরা অতীতের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে জলবুদ্ধ ও মা গঙ্গাদেবীর কাছে প্রার্থনা করি, যেন আগামী বছর সুখ ও শান্তিতে কাটে।’
সিদ্ধাঙ্গনা চাকমা বলেন, ‘চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের মানুষজন প্রতিবছরই এভাবেই সাঙ্গু নদীতে ফুল বিজু উদযাপন করে। এটি আমাদের ঐতিহ্য এবং আত্মিক শান্তির উৎস।’
বসুন্ধরা শুভসংঘ বান্দরবান জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক রবিন তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর অন্যতম প্রধান ও সর্বাধিক আনন্দঘন উৎসব বিষু উৎসব, যা তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের পাশাপাশি এই অঞ্চলে বসবাসরত সকল জাতিগোষ্ঠী তাদের নিজ নিজ বিশ্বাস, রীতি নীতির মাধ্যমে পালন করে থাকে। বিষুর প্রথম দিনকে বলা হয় ‘ফুল বিষু’।
ফুল বিষু তে ‘গঙা মা’ (জলদেবী) উদ্দেশ্যে কলাপাতায় সাজানো রঙিন ফুল, জ্বলন্ত মোমবাতি দিয়ে প্রার্থনার মাধ্যমে তারা অতীতের ভুলভ্রান্তির ক্ষমা চেয়ে ভবিষ্যতের শান্তি, সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করেন। এটি শুধু একটি ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠান নয়, বরং একটি জাতির জীবনযাত্রা, বিশ্বাস, প্রকৃতিপ্রেম ও ঐতিহ্যের মিলিত রূপ। যা আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের ঐতিহ্য, মানবতা, প্রকৃতিপ্রীতি এবং সহাবস্থানের শিক্ষা নিয়ে যুগ যুগ ধরে পালন করে আসছে।
এই বিষু তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে আরো আনন্দঘন হয়ে ওঠে যখন ফুল বিষুর দিনে হাজার বছর আগে থেকে চলা ‘ঐতিহ্যবাহী ঘিলা খেলা’ সম্মিলিতভাবে আয়োজন করা হয়।
বান্দরবান জেলা শাখার সভাপতি উয়ই সিং মার্মা বলেন, পার্বত্য অঞ্চলের প্রাচীন ও প্রাণের উৎসব বিজু। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ফুল সংগ্রহ করে তা নদী, ও প্রবহমান জলধারায় ভাসিয়ে দেন। এই ফুল ভাসানো এক ধরনের উদ্দেশ্য জল-বুদ্ধ আধ্যাত্মিক প্রার্থনা, যেখানে সবাই অতীতের দুঃখ-কষ্ট মুছে নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে শান্তি, সুখ ও সমৃদ্ধির প্রার্থনা করে। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে তরুণ-তরুণী ও প্রবীণরা সকলে মিলে এই আয়োজনে অংশ নেয়। ফুল দিয়ে ঘরবাড়ি সাজানো হয়, চারপাশে তৈরি হয় এক আনন্দঘন পরিবেশ। এই উপলক্ষে বিভিন্ন পাহাড়ি গ্রামে আয়োজন করা হয় ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনার। আমরা গর্বিত ও আনন্দিত যে এবারের ফুল বিজুতে বসুন্ধরা শুভসংঘ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। বসুন্ধরা শুভসংঘ সবসময়ই শিক্ষা, সংস্কৃতি ও খেলাধুলার উন্নয়নে সমাজের পাশে রয়েছে এবং আগামীতেও এ ধারা অব্যাহত রাখবে।