ইসলাম সংঘাত নয়, মানবজাতির ঐক্যের তত্ত্বকে সামনে এনেছে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনার শাসক হিসেবে এ ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালিয়েছেন। চার মহান খলিফার খেলাফতের আমলেও এ তত্ত্ব অনুসৃত হয়েছে। খলিফা হজরত আলী (রা.)-এর খুতবা, বক্তৃতা, শিক্ষণীয় উক্তি এবং চিঠিপত্রের সংকলিত গ্রন্থ 'নাহজ্জল বালাগাহে' মানবজাতির ঐক্যের প্রতি ইসলামের প্রসন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরা হয়েছে। ইসলামে যেমন ধর্মীয় ঐক্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তেমনি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে মানবজাতির ঐক্যের প্রতি। ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতা'আলা রাব্বুল মুসলিমীন বা মুসলমানদের পালনকর্তা শুধু নন, তিনি হলেন রাব্বুল আলামিন অর্থাৎ সমগ্র বিশ্ববাসীর পালনকর্তা। ইসলামী খেলাফতের শাসনামলে সে সময়ের খ্রিস্টান অধ্যুষিত মিসরের গভর্নর মালিক আশতারের কাছে খলিফা হজরত আলী (রা.) যে চিঠি লিখেছিলেন তা নাহজ্জল বালাগাহতে সংকলিত রয়েছে। চিঠিতে হজরত আলী (রা.) স্পষ্ট করেছেন বিভিন্ন গোত্রীয়, জাতিগত ও ভাষাগত গোষ্ঠীতে বিভক্ত হওয়া এবং বিভিন্ন চিন্তা ও মতাদর্শ বহুধা বিভক্ত করে ফেলা সত্ত্বেও সমগ্র মানবজাতি হচ্ছে একটি বিরাট সম্প্রসারিত অভিন্ন পরিবার।
খলিফা হজরত আলীর (রা.) চিঠিতে মিসরের গভর্নরকে নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়- 'তোমার অন্তরকে তোমার অধীন জনগণের প্রতি ক্ষমা এবং তাদের প্রতি স্নেহশীলতা ও দয়ার্দ্রতায় অভ্যস্ত করে তোল। তুমি তাদের ওপর লোভী হিংস্র পশুর ন্যায় চড়াও হয়ো না, যারা মনে করে যে, তাদের খেয়ে ফেলাই যথেষ্ট। কারণ, তারা (তোমার অধীন জনগণ) দুই ধরনের : হয় তোমার দিনি ভাই, নয়তো সৃষ্টি হিসেবে তোমারই মতো। তারা বিচ্যুত হবে এবং ভুলের শিকার হবে। তারা ভুল কাজ করতে পারে, তা ইচ্ছা করেই হোক বা উদাসীনতার কারণেই হোক। অতএব, তুমি ঠিক সেভাবেই তাদের দিকে ক্ষমার হস্ত প্রসারিত করে দাও যেভাবে তুমি পছন্দ কর যে, আল্লাহ তোমার প্রতি ক্ষমা বিস্তার করে দিন। কারণ, তুমি তাদের ওপরে স্থান লাভ করেছ এবং তোমার দায়িত্বশীল অধিনায়ক (খলিফা) তোমার ওপরে, আর যে (খলিফা) তোমাকে নিয়োগ করেছে তার ওপরে আছেন আল্লাহ। তিনি (আল্লাহ) চেয়েছেন যে, তুমি তাদের বিষয়াদি পরিচালনা করবে এবং তিনি তাদের মাধ্যমে তোমাকে পরীক্ষা করছেন।'
চিঠিতে নাগরিকদের সুবিচারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। সুবিচারের ক্ষেত্রে পক্ষপাতহীন মনোভাব পোষণেরও তাগিদ দেওয়া হয়েছে চিঠিতে। খলিফা হজরত আলী (রা.) বলেন, 'আল্লাহর খাতিরে সুবিচার কর এবং লোকদের প্রতি সুবিচার কর, এমনকি তোমার নিজের, তোমার ঘনিষ্ঠজনদের ও তোমার অধীন যাদের তুমি ভালোবাসো তাদের বিরুদ্ধে হলেও। কারণ, তুমি তা না করলে তুমি হবে জালেম, আর কোনো ব্যক্তি যখন আল্লাহর সৃষ্টির ওপর জুলুম করে তখন আল্লাহ স্বয়ং তাঁর সৃষ্টির পক্ষ থেকে ওই ব্যক্তির প্রতিপক্ষ হয়ে যান।... জুলুম অব্যাহত রাখার তুলনায় অধিকতর গুরুতর কিছু নেই, যা আল্লাহর অনুগ্রহকে ফিরিয়ে দেয় বা তাঁর প্রতিশোধকে এগিয়ে নিয়ে আসে...।'
হজরত আলী (রা.) মালিক আশতারকে সুবিচারের ক্ষেত্রে ভাবাবেগকে অনুসরণ না করার ব্যাপারে সতর্ক করে দেন এবং ভাবাবেগমুক্ত থাকার পরামর্শ দেন। খলিফা হজরত আলী (রা.) লেখেন- 'অন্তরে ভাবাবেগ জাগ্রত হলে তখন (কোনোরূপ সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে) বিরত থাকা উচিত। কারণ, আল্লাহর অনুগ্রহ না হলে মানুষের অন্তঃকরণ তাকে পাপের দিকে নিয়ে যায়।... অতএব, তুমি তোমার ভাবাবেগকে নিয়ন্ত্রণ কর এবং যা তোমার জন্য বৈধ নয় সে কাজ থেকে তোমার অন্তরকে বিরত রাখ। কারণ, অন্তরকে নিয়ন্ত্রণ করা মানে অন্তর যা পছন্দ করে ও যা অপছন্দ করে তাকে এ দুয়ের মাঝখানে ধরে রাখা।'
হজরত আলী (রা.) চিঠিতে সমাজে সুবিচার বাস্তবায়নে ক্ষমাসুন্দর মনোভাব পোষণের জন্য মিসরের গভর্নরকে নির্দেশনা দেন। তিনি লেখেন- 'ক্ষমা করার কারণে অনুতপ্ত হয়ো না এবং শাস্তি দিতে পেরে গর্বিত হয়ো না। ক্রোধের সময় দ্রুত পদক্ষেপ নিও না যদি তোমার পক্ষে তা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। এ কথা বল না যে, 'আমাকে কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে; অতএব, আমি যখন আদেশ দেব তখন অবশ্যই তা পালিত হতে হবে।' কারণ, তা অন্তরে বিভ্রান্তি ও দিনে দুর্বলতা সৃষ্টি করে এবং তা ব্যক্তিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।'
হজরত আলী (রা.) তার গভর্নরকে উপদেশ দিতে গিয়ে পুনরায় বলেন : 'তোমার জন্য সর্বাধিক বাঞ্ছনীয় হওয়া উচিত তা-ই যা সর্বাধিক ন্যায়ানুগ, যা সর্বাধিক মাত্রায় সর্বজনীন সুবিচারপূর্ণ এবং তোমার অধীনদের পছন্দের দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বাধিক বোধগম্য।'
লেখক : ইসলামী গবেষক