রমজান মুমিনের জন্য প্রশিক্ষণকাল। এই মাসে মুমিন সুনিয়ন্ত্রিত পুণ্যময় জীবনে অভ্যস্ত হয় এবং বছরের অন্য মাসগুলো সে অনুযায়ী জীবন যাপন করে। সুতরাং রমজানে মুমিন আল্লাহর আনুগত্য, পুণ্যের কাজ, ইবাদত, প্রবৃত্তিপূজা ও আল্লাহর অবাধ্যতা পরিহারের অনুশীলন করে। সেই অনুশীলন হতে পারে নিচের সময়সূচি অনুযায়ী, কোরআন, হাদিস ও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দৈনন্দিন জীবনের আলোকে যা সাজানো হয়েছে :
ক. রমজানে মুমিনের সকাল
১. আজানের উত্তর প্রদান : একজন মুমিনের দৈনন্দিন জীবন শুরু হয় ফজরের আজান শুনে। সে প্রথমেই আজানের উত্তর দেয় এবং আজানের দোয়া পাঠ করে। আজানের উত্তর প্রদানকারীর ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামাতের দিন সে আমার সুপারিশ লাভ করবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬১৪)
২. ফজরের সুন্নত : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ফজরের দুই রাকাত সুন্নত দুনিয়া ও তার মধ্যে যা আছে তা থেকে উত্তম।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৭২৫)
৩. জামাতে ফজর আদায় : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘রাতের আঁধারে মসজিদে আগমনকারীদের কিয়ামতের দিন পূর্ণ আলো লাভের সুসংবাদ দাও।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৫৬১)
৪. জিকির ও তাসবিহ পাঠ : ফজরের নামাজের পর পুরুষরা মসজিদে এবং নারীরা জায়নামাজে বসে জিকির, তিলাওয়াত ও তাসবিহ পাঠ করবে। কেননা ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) ফজর নামাজ শেষে সূর্য পরিপূর্ণ উদিত হওয়া পর্যন্ত চারজানু হয়ে স্বস্থানে বসে থাকতেন।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪৮৫০)
৫. ইশরাক পড়া : মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ জামাতে আদায় করে, তারপর সূর্য ওঠা পর্যন্ত বসে বসে আল্লাহর জিকির করে, এরপর দুই রাকাত নামাজ আদায় করে তার জন্য একটি হজ ও একটি ওমরার সওয়াব রয়েছে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৫৮৬)
৬. দান করা : প্রতিদিন সকালে ফেরেশতারা দানকারীর জন্য দোয়া করে। তাই দানের মাধ্যমে দিন শুরু করা উত্তম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে দুজন ফেরেশতা অবতরণ করেন। তাঁদের একজন বলেন, হে আল্লাহ! দাতাকে তার দানের উত্তম প্রতিদান দিন আর অপরজন বলেন, হে আল্লাহ! কৃপণকে ধ্বংস করে দিন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৪৪২)
খ. রমজানে মুমিনের দুপুর
১. হালাল জীবিকার অনুন্ধান : কারো উপার্জন হারাম হলে রমজানে সে তা থেকে ফিরে আসার চেষ্টা করবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কাজের সন্ধানে পথ চলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৬৯৯)
২. জোহরের নামাজের প্রস্তুতি : জোহরের আজানের উত্তর দেওয়া, নামাজের প্রস্তুতি নেওয়া ও জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করা।
৩. সুন্নত নামাজে যত্নশীল হওয়া : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি দিনে ও রাতে ১২ রাকাত (সুন্নত) নামাজ আদায় করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে ঘর নির্মাণ করবেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৭২৮)
৪. পারিবারিক কাজে সহযোগিতা : আয়েশা (রা.) বলেন, ‘নবী (সা.) জুতা ঠিক করতেন, কাপড় সেলাই করতেন এবং তোমরা যেমন ঘরে কাজ করো তেমনি কাজ করতেন।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২৫৩৮০)
গ. রমজানে মুমিনের বিকেল
১. আসরের নামাজের প্রস্তুতি : আসরের আজানের উত্তর প্রদান, নামাজের প্রস্তুতি ও মসজিদে জামাতের সঙ্গে আসরের নামাজ আদায়।
২. মসজিদে দ্বিনি মজলিসে অংশ নেওয়া : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় শুধু কল্যাণকর বিষয় শেখা বা শেখানোর জন্য মসজিদে গেল সে একটি পূর্ণাঙ্গ হজের সওয়াব পাবে।’ (সুনানে তাবারানি)
৩. কোরআন তিলাওয়াত : আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রমজান মাসের প্রতি রাতে জিবরাইল (আ.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হতেন এবং তাঁরা উভয়েই পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করে একে অপরকে শোনাতেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৬)
৪. ইফতারের আগে দোয়া : ইফতারের আগে রোজাদারের দোয়া কবুল হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না : ন্যায়পরায়ণ শাসক, রোজাদার যখন সে ইফতার করে এবং অত্যাচারিত ব্যক্তির দোয়া।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৭৫২)
৫. সাদাসিধে ইফতার : মহানবী (সা.) খুবই সাদাসিধে ইফতার পছন্দ করতেন। আবদুল্লাহ বিন আবি আউফ (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রোজায় আমরা রাসুল (সা.)-এর সফরসঙ্গী ছিলাম। সূর্যাস্তের সময় তিনি একজনকে ডেকে বলেন, ছাতু ও পানি মিশিয়ে ইফতার পরিবেশন করো।’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস : ১০৯৯)
ঘ. রমজানে মুমিনের রাত
১. মাগরিব নামাজের প্রস্তুতি : মাগরিবের আজানের উত্তর প্রদান ও জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায়।
২. জিকির ও তাসবিহ পাঠ : হাদিসে উল্লিখিত সন্ধ্যার জিকির ও তাসবিহ পাঠ।
৩. পরিবারে দ্বিনচর্চা : পরিবারের সবার খোঁজখবর নেওয়া এবং সময় থাকলে দ্বিনি বিষয়ে আলোচনা করা অথবা কোনো বুজুর্গ আলেমের গ্রন্থ পাঠ করা। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি উপদেশ দিতে থাকো। কেননা উপদেশ মুমিনদেরই উপকারে আসে।’ (সুরা জারিয়াত, আয়াত : ৫৫)
৪. এশার নামাজের প্রস্তুতি : রাসুলুল্লাহ বলেন, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ঘরে পবিত্রতা অর্জন করে এবং পায়ে হেঁটে কোনো মসজিদে ফরজ নামাজ আদায়ের জন্য যায়, তাহলে তার এক পদক্ষেপে একটি পাপ মার্জনা হয় এবং অপর পদক্ষেপে একটি মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৬৬৬)
৫. এশার নামাজের প্রস্তুতি : এশার আজানের উত্তর দেওয়া, জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় এবং এশার সুন্নত নামাজ পড়া।
৬. জামাতের সঙ্গে তারাবির নামাজ আদায় : মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইমামের সঙ্গে তারাবির নামাজ আদায় করে ঘরে ফেরে আল্লাহ তার জন্য পূর্ণ রাত নামাজ আদায় করার সওয়াব লিখে রাখেন।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ১৬০৫)
৭. তাহাজ্জুদ আদায় ও সাহরি খাওয়া : রমজানে তাহাজ্জুদ পড়ার বিশেষ সুযোগ থাকে। আর সাহরি খাওয়া সুন্নত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা সাহরি খাও। কেননা সাহরিতে বরকত রয়েছে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯২৩)
বিডি প্রতিদিন/ সালাহ উদ্দীন