দীর্ঘদিন ধরে ভিসা জটিলতায় ভুগছেন আমিরাত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। শ্রমিকদের জন্য নতুন ভিসা প্রদান যেমন বন্ধ রয়েছে, তেমনি সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা ভিসা পরিবর্তন তথা কর্মস্থল পরিবর্তনের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনকি কর্মসংস্থানের জন্য আমিরাতে আসতে আগ্রহীরাও গুনছে দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর।
ভিসা বন্ধের দুই বছরের মধ্যে কয়েকবার ব্যক্তিগত ও সরকারি সফরে বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা আমিরাত ঘুরে গেলেও সরকারের উচ্চপদস্থ নীতি নির্ধারকদের থেকে ভিসার ব্যাপারে এখনেও আসেনি কোনো আশার বাণী। এতে করে সরকারের ওপর থেকে প্রবাসীদের আস্থা কমছে , অন্যদিকে ভিসা জটিলতায় ভুক্তভোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় কমছে রেমিট্যান্স প্রেরণের উৎসাহ। এমনকি নতুন শ্রমিক আমিরাতে ঢুকতে না পারায় বাংলাদেশ হারাতে বসেছে বড় এই শ্রমবাজার।
শ্রমিক ভিসাসংক্রান্ত জটিলতা অবসান হওয়ার আগেই এবার আমিরাতে সিকিউরিটি পেশায় নিয়োজিত বাংলাদেশিদের ভিসা ও পিএসবিডি লাইসেন্স নবায়নে সৃষ্টি হয়েছে নতুন সমস্যা। আমিরাতের সিকিউরিটি পেশায় কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকরা অভিযোগ করে বলছেন, 'ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের যথাসময়ে সিকিউরিটি লাইসেন্স তথা পিএসবিডি কার্ড নবায়ন করতে দেওয়া হলেও বাংলাদেশি সিকিউরিটি কারোরই লাইসেন্স নবায়ন করছে না এখানকার প্রাইভেট সিকিউরিটি বিজনেস ডিপার্টমেন্ট।'
তাদের দাবি, গত জানুয়ারি মাস থেকে এই সমস্যা শুরু হয়েছে। পিএসবিডি লাইসেন্স নবায়ন করতে না পারায় গত দুই মাসে অনেক বাংলাদেশিকে কোম্পানি থেকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলেও জানিয়েছে তারা। তাদের মধ্যে গ্রুপ ফোর, আলজাবের কইন সিকিউরিটি গ্রুপ, স্পার্ক সিকিউরিটি, স্টার সিকিউরিটিসহ বেশ কিছু কোম্পানিতে বাংলাদেশি সিকিউরিটিরা কর্মরত ছিলেন।
এদিকে, পিএসবিডি লাইসেন্স নবায়ন না হওয়ায় ও বাংলাদেশিদের জন্য কর্মস্থল পরিবর্তনের সুযোগ না থাকায় ভুক্তভোগী এই সিকিউরিটিরা অন্য কোম্পানিতেও ভিসা লাগাতে পারছে না। যার ফলে কোম্পানি তাদের দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন তারা।
সাগর আহমেদ নামে আলজাবের কইন সিকিউরিটি কোম্পানির একজন সিকিউরিটি সরাসরি অভিযোগ করে বলেন, 'গত ৪ বছর ধরে আমি এই কোম্পানিতে চাকরি করছি। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে পিএসবিডি কার্ডের মেয়াদ শেষ হয়। এর আগে দু'বার কার্ড নবায়ন হয়েছে। একইভাবে এ বছর জানুয়ারি মাসে পিএসবিডি পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়। কিন্তু পরীক্ষায় পাস করলেও পিএসবিডি কার্ড আসেনি।
আবুধাবী, দুবাই, আল-আইন, শারজাহ, ফুজিরা, আজমানসহ আমিরাতের বিভিন্ন বিভাগে কয়েক হাজার বাংলাদেশি বিভিন্ন সিকিউরিটি কোম্পানিতে কাজ করছেন। পিএসবিডি লাইসেন্স নবায়ন না হওয়ায় এবং দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার ভয়ে সবাই খুব দুশ্চিন্তায় রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কনস্যুলেট দুবাইয়ের প্রথম সচিব (শ্রম) একেএম মিজানুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, 'সিকিউরিটিদের এসব অভিযোগ ও সমস্যার কথা আমরা শুনেছি। তারা এ সম্পর্কে বেশ কিছু মেইল করেছে, মোবাইলেও অভিযোগ জানিয়েছে। এরপর আমরা অনেক সিকিউরিটির সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। যাদের লাইসেন্স নবায়ন হচ্ছে তাদের সঙ্গেও কথা বলে জানতে পেরেছি এটা আসলে সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। তবে অভিযোগ পাওয়ার পর আমরা দুবাই ফরেন মিনিস্ট্রি ও শারজাহ ফরেন মিনিস্ট্রির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানিয়েছি।'
অন্য দেশের প্রবাসীদের এই কার্ড দেওয়া হলেও শুধু বাংলাদেশি নাগরিকদের এটি দেওয়া হচ্ছে না কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। বাংলাদেশি নাগরিকদের যে শুধু পিএসবিডি কার্ড দেওয়া হচ্ছে না বিষয়টি এমন নয়। অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি আছে যাদের লাইসেন্স রিনিউ হচ্ছে। আমার ধারণা, এটা কোম্পানির অভ্যন্তরীণ কোনও সমস্যা। অথবা তারা এই লাইসেন্স নবায়নের আগে যে মেডিকেল হয় তাতে কোনো কারণে ফেল হয়েছে। তাদেরও তো কোনও সমস্যা থাকতে পারে। যার জন্য কোম্পানি তাদের দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে।'
অন্যদিকে, শ্রমিক ভিসার সমস্যার সৃষ্টি হওয়ার দুই বছরেও এর সুরাহার পথ সুগম না করতে পারায় বাংলাদেশ সরকারের ওপর হতাশ আমিরাত প্রবাসীরা। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মুখে যদিও শোনো যায় ভিসা চালু হচ্ছে বা চালু হওয়ার খবর। কার্যত আমিরাতে বাংলাদেশি নারী শ্রমিকের ভিসা ছাড়া অন্য কোনো শ্রম ভিসাই পাওয়া যাচ্ছে না। তবে দূতাবাস ও কনসুু্যলেট থেকে বলছে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য দেওয়া হচ্ছে ফ্রি-জোনের ভিসা।
কী ধরনের ভিসা চালু আছে- এমনটি অনুসন্ধান করতে বেশ কিছু টাইপিং সেন্টারে যোগাযোগ করে জানা গেছে, নারী শ্রমিকের পাশাপাশি পার্টনারশিপ ভিসারও ব্যবস্থা করতে পারছে টাইপিং সেন্টার। দুবাইয়ের আল মুনির টাইপিং, আল মারুফ টাইপিং ও ইন্ডিয়ান আল বারাহা টাইপিং মালিকরা বলছেন, বাংলাদেশিদের জন্য পার্টনার বা শেয়ার হোল্ডার ভিসা পাওয়া যাচ্ছে। দশ হাজার দিরহাম জমা করে কোনো কোম্পানির/ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে এই ভিসা লাগানো যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশি নারী শ্রমিকদের ভিসা সচরাচর খোলা রয়েছে।
যদিও নারী শ্রমিকদের বিদেশে প্রেরণের ক্ষেত্রে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার প্রশ্ন উঠে বারবার। তবুও প্রথম সচিব (শ্রম) একেএম মিজানুর রহমান বলছেন, 'নারী-পুরুষ সমান বিবেচনায় রেখে বৈদেশিক শ্রমবাজারকে মূল্যায়ন করে বাংলাদেশ সরকার। সরকার মনে করে পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি নারীরাও অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে। তাই ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে সার্টিফিকেট দিয়ে নারীদের বিদেশে পাঠায়। তারই ধারাবাহিকতায় নারী শ্রমিক আসছে মধ্যপ্রাচ্যসহ নানা দেশে। তবে ১০০ জনের মধ্যে দুই/চারজনের সমস্যা হয়। যদি সে রকম কোনো সমস্যার কথা আমরা জানতে পারি তবে সেগুলো আমরা সমাধান করি।'
তবে টাইপিং সেন্টারগুলোর দাবি, তারা ভ্রমণ ভিসা করতে পারছে না।
এ অভিযোগের ভিত্তিতে একেএম মিজানুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, 'ভ্রমণ ভিসার সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। যিনি ভ্রমণ ভিসা নিয়ে আসতে চান, তিনি তার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেওয়ার পর এখানকার কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করলে তারপর আসতে পারে। যেহেতু তারা ভ্রমণকারী সেহেতু ভ্রমণ ভিসা সত্যায়িত করা লাগে না। এ ক্ষেত্রে কনস্যুলেট বা দূতাবাসের কোনও দায়িত্ব নেই।
এর আগে দুবাই সফরে আসা বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, প্রবাসীদের ভিসা সমস্যা সমাধান লক্ষ্যে আমিরাত সফর করবেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তবে প্রবাসীদের বহু প্রতীক্ষার অবসানকল্পে এরশাদ কবে নাগাদ আমিরাত সফর করবেন আর কখন ভিসা চালু হবে সেই প্রশ্নই এখন ঘুরপাক করছে আমিরাতে অবস্থানরত লাখো প্রবাসীর মনে।