মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে বাংলাদেশে মানবাধিকার বিষয়ক একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে ২৯ জুলাই। এতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে দেশের সকল নাগরিক, বিশেষত: সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার রক্ষা করার জন্যে যথাযধ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাস প্রতিরোধের আহবান জানানো হয়েছে এতে।
জামাত-শিবিরের সন্ত্রাসী তৎপরতা ঠেকাতে কঠোর হবার প্রসঙ্গও রয়েছে এ প্রস্তাবে।
উল্লেখ্য, প্রস্তাবটি কয়েক সপ্তাহ আগে উত্থাপনের জন্যে তৈরী করা হয় বিধায় প্রস্তাবের ভাষায় অনেক কিছুই গড়মিল মনে হতে পারে। কারণ, এখন আর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা কিংবা হরতাল-অবরোধের মত পরিস্থিতি বিরাজিত নেই। সরকারের কৌশলী পদক্ষেপে মোটামুটি সবকিছু শান্ত রয়েছে।
আরিজোনার রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান এবং প্রতিনিধি পরিষদে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল সম্পর্কিত সাব কমিটির চেয়ারম্যান ম্যাট স্যালমন এবং ইলিনয়ের রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান বব ডোল্ড এর সর্বাত্মক সমর্থনে প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভ’ত আমেরিকান এবং হাওয়াই অঙ্গরাজ্যের কংগ্রেসওম্যান (ডেমক্র্যাট) তুলসী গ্যাবার্ড। অর্থাৎ প্রস্তাবটি রিপাবলিকান ও ডেমক্র্যাট- উভয় দলের উদ্যোগে উত্থাপিত হয়েছে।
এটি উত্থাপনের সময়ে দেয়া বক্তব্যে তুলসী গ্যাবার্ড বলেছেন, হিন্দু সম্প্রদায়কে দেশ ছাড়া করার যে হিংস্র প্রবণতা চলছে বাংলাদেশে, তা বন্ধের জন্যে অবশ্যই সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। তুলসী গ্যাবার্ড বলেন, ‘বাংলাদেশ গোলযোগের মধ্যে রয়েছে। গত বছর ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের পর থেকেই এ দেশের স্থিতিশীলতা নিয়ে দেখা দিয়েছে ব্যাপক উদ্বেগ।’
এ প্রস্তাবের বলিষ্ঠ সমর্থক কংগ্রেসম্যান বব ডোল্ড বলেন, ‘কোন দেশ তার নাগরিকদের, বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষায় ব্যর্থ হলে তা বরদাশত করা হবে না। বিশ্বের মানবিক মূল্যবোধের বৃহৎ শক্তি হিসেবে সে সব দেশের কাছে যুক্তরাষ্ট্র একসুরে এই বার্তা পাঠাতে বাধ্য।’
উল্লেখ্য যে, এই প্রস্তাবটি উত্থাপনে যে সব সংগঠন দীর্ঘদিন যাবত কাজ করছিলো তার অন্যতম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, সেন্টার ফর ইনক্যুয়ারি, আমেরিকান হিউম্যানিস্ট এসোসিয়েশন, মুক্তমনা, দৃষ্টিপাত, দেলওয়ারে ভ্যালী বাংলাদেশী এসোসিয়েশন, সেক্যুলার কোয়ালিশন অব আমেরিকা, হিন্দু আমেরিকান ফাউন্ডেশন।
এ প্রস্তাব উত্থাপনের জন্যে প্রতিনিধি পরিষদের সাথে দীর্ঘদিন দেন-দরবারকারিদের অন্যতম বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের যুক্তরাষ্ট্র শাখার সংগঠক শিতাংশু গুহ জানান, ‘ধর্মের নামে উগ্রপন্থি দমনের ব্যাপারটিকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এ প্রস্তাব উত্থাপনী বক্তব্যে। ধর্মীয় চরমপন্থিরা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে বিপন্ন করে তোলার অপচেষ্টা চালাচ্ছে জামাত-শিবিরের ব্যানারে। জামাত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের বহু পুরনো দাবির বাস্তবায়ন ঘটলে বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ অনেকটা কমবে।’
কংগ্রেসওম্যান তুলসী গ্যাবার্ড বলেছেন, ‘সংখ্যালঘুদের হামলায় জড়িতরা খুব কম সময়েই বিচারের সম্মুখীন হচ্ছে বা শাস্তি পাচ্ছে।’
এ উপলক্ষে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল সম্পর্কিত সাব কমিটির চেয়ারম্যান ম্যাট স্যালমন বলেন, ‘কংগ্রেসওম্যান গ্যাবার্ডের সাথে এমন একটি মানবিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যে কাজ করতে পেরে আমি গর্বিত। বাংলাদেশের সম্ভাবনা প্রচুর। আমরা বাংলাদেশের প্রতি উদাত্ত আহবান জানাচ্ছিন সহিংস রাজনীতি পরিহারের জন্যে। একই সাথে আইনের শাসন সুসংহত এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে জোরদার করার পাশাপাশি ধর্মীয় উগ্রপন্থি দমনে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নেবে বলে আশা করছি।’
কংগ্রেসম্যান বব ডোল্ড অপর এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন, ‘সারাবিশ্বেই ধর্মীয় কারণে নির্যাতনের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৭৭% বসবাস করছেন এমন দেশে যেখানে ধর্মীয় স্বাধীনতার বিরুদ্ধে নানা মতবাদ বিরাজ করছে। বিশ্বের মানবতা সমুন্নত রাখতে সোচ্চার রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র উচ্চারণ করতে চায় যে, নাগরিকদের মৌলিক স্বাধীনতা, বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার সুরক্ষায় যে সব রাষ্ট্র ব্যর্থ হচ্ছে তাদেরকে কোনভাবেই সহ্য করা হবে বা। আমি সহকর্মী কংগ্রেসম্যানদের সাথে একযোগে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষা, চরমপন্থিদের নির্মূল করা এবং আইনের শাসন পুনপ্রতিষ্ঠার জন্যে।
এ প্রস্তাবে বলা হয়েছে: (১). ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে স্বাধীনতা লাভ করেছে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আবাসভূমি হিসাবে;
(২). ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী স্থানীয় মিলিশিয়া (আলবদর, রাজাকার, আল শামস এবং তথাকথিত শান্তি বাহিনী) দের সহায়তায় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে এর ভুরি ভুরি প্রমাণ রয়েছে।
(৩). যদিও সংখ্যা নিয়ে মতানৈক্য আছে, তবু বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ঐসময় ৩০ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছে, ১ কোটি মানুষ বিতাড়িত হন এবং ২ লক্ষ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছে; ইউএস সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী (বর্তমানে প্রয়াত) মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সিনেট ফ্লোরে পাকিস্তানীদের বর্বরতার নিন্দা করেছেন এবং সিনেট জুডিশিয়ারি কমিটির হিয়ারিং-এ এক রিপোর্টে লিখেছেন, ‘মার্কিন সরকারের ফিল্ড-রিপোর্ট; অসংখ্য প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকের রিপোর্ট; বিবিধ আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমন বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য সংস্থার প্রদত্ত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, পূর্ব-বাংলায় (পূর্ব-পাকিস্তানে) সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে হিন্দুরা, তাদের জমিজমা কেড়ে নেয়া হয়েছে, তাদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে, এবং কোথাও কোথাও তাদের 'এইচ' চিহ্ন দিয়ে মার্কা দেয়া হয়েছে। আর এসবই করা হয়েছে ইসলামাবাদ থেকে সামরিক শাসনের আওতায় সরকারী নির্দেশ বলে।
(৪). যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক জুরিস্ট কমিশনের (আইসিজে) এক রিপোর্টে নিশ্চিত করা হয়েছে যে, পাকিস্তানী মিলিটারী ও দেশীয় প্যারামিলিটারি মিলিশিয়ারা এক কোটি হিন্দুকে সমূলে নির্মূল বা বিতাড়িত করার উদ্যোগের জন্যে দায়ী।
(৫). বাঙালী জাতীয়তাবাদীরাও যুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সমর্থক বলে বিহারীদের ওপর আক্রমন চালিয়েছে।
(৬) একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্যে গঠিত ‘আন্তর্জাতিক ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল’-এর বিপক্ষে বিএনপি-জামাত (জেইআই), ইসলামী ছাত্র শিবির (আইসিএস) ও তাদের সমর্থকরা সহিংস দাঙ্গা করেছে, ডজন ডজন বোমা ফুটিয়েছে, রেললাইন উপড়ে ফেলেছে, নিরাপত্তা রক্ষীদের ওপর আক্রমণ করেছে, জোর করে ব্যবসা-বানিজ্য বন্ধ রেখেছে এবং এতে সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়েছে।
(৭). বিএনপি-জামাত (জেইআই), ছাত্র শিবির (আইসিএস) ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর হিন্দুদের ওপর আক্রমন করেছে এবং এতে প্রায় ৫০টি মন্দির ও ১৫০০ ঘরবাড়ী ধ্বংস হয়েছে।
(৮). সন্ত্রাসের পর এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশানাল শংকা প্রকাশ করে বলেছে, 'বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় চূড়ান্ত রিস্কের মধ্যে আছে' এটা দু:খজনক যে, তারা শুধুমাত্র তাদের ধর্মের কারণেই আক্রান্ত। কর্তৃপক্ষের উচিত এদের যথাযথ নিরাপত্তা বিধান করা।
(৯). সাম্প্রতিক নির্বাচনের আগে-পরে একইভাবে বিএনপি-জামাত (জেইআই), ছাত্র শিবির (আইসিএস) হিন্দুদের ওপর আক্রমন চালিয়েছে। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ-এর মতে এতে ৪৯৫টি হিন্দুবাড়ী ক্ষতিগ্রস্ত, ৫৮৫টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত বা লুট; ১৬৯টি মন্দির ধ্বংস হয়েছে।
(১০). ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদীরা বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও আহমদিয়াদের ওপরও আক্রমন চালিয়েছে।
(১১). জামাত (জেইআই), ছাত্র শিবির (আইসিএস) ও অন্যান্য চরমপন্থী গ্রুপ যেহেতু দেশের স্থিতিশীলতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর হুমকি স্বরূপ, সেহেতু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সন্ত্রাসের আশংকা সবসময় থেকেই যায়।
(১২). সাম্প্রতিক ক্রটিপূর্ণ নির্বাচন দেশে সহিংসতার জন্ম দিতে পারে যা বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের জন্যে হুমকিস্বরূপ।
(১৩). উদ্যত চাপাতিধারী ইসলামী মৌলবাদীরা এ বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারী বাংলা একাডেমি বইমেলায় পুলিশের সামনে নিরেশ্বরবাদী মার্কিন নাগরিক অভিজিত রায়কে হত্যা ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমদকে আহত করেছে।
(১৪). ইসলামী মৌলবাদীদের নিরেশ্বরবাদী বা অবিশ্বাসীদের ওপর হামলা করার একটি ইতিহাস আছে এবং এ পর্যন্ত গত ১১ বছরে ৮ জন খুন হয়েছে এবং আরও কয়েক ডজন পালিয়ে জীবন বাঁচাচ্ছে।
(১৫). ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর বারংবার আক্রমন, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি এবং জামাত (জেইআই)-ছাত্র শিবির (আইসিএস) ও চরমপন্থী গ্রুপের দ্বারা ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি বাংলাদেশে মার্কিন অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
(১৬). গত বছর থেকে ইরাক ও সিরিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রো-ইসলামিক স্টেট-এর সাথে সম্পৃক্ত বেশ কিছু চরমপন্থী গ্রেফতারে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশে ইসলামিক চরমপন্থা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
(১৭). যুক্তরাষ্ট্রের উচিত বাংলাদেশের সাথে আরো ঘনিষ্ঠভাবে উভয়পক্ষের স্বার্থরক্ষায় নিযুক্ত হওয়া, যাতে বাংলাদেশে মানবাধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতন্ত্র বজায় থাকে এবং যাতে ধর্মীয় মৌলবাদ ও চরমপন্থা প্রতিরোধ করা যায়।
সেই লক্ষ্যে হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ প্রস্তাব নিচ্ছে যে, ১. ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ভিকটিমদের কথা স্বীকার করছে, ২. বাংলাদেশ সরকারকে আহবান জানাচ্ছে, আইনের শাসন, নির্বাচন প্রক্রিয়া ও যুদ্ধাপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে চলতে, ৩. বাংলাদেশ সরকারকে আহবান জানাচ্ছে, চরমপন্থী গ্রুপ যেমন জামাত (জেইআই), ছাত্র শিবির (আইসিএস)-যারা দেশের ধর্মনিরপেক্ষ, গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতার জন্যে হুমকিস্বরূপ তাদের কর্মকান্ড ঠেকাতে, ৪. বাংলাদেশ সরকারকে আহবান জানাচ্ছে, সকল নাগরিকের বিশেষত: দুর্বল ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষার।