নিউইয়র্কে এক সমাবেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনকারী এবং জাসদ নেতা আ স ম আব্দুর রব বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ‘মানুষের মুখ বন্ধ করে রাখার পরিণতি ভয়াবহ। ইতিহাস সে সাক্ষ্য দেয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার চারদিকে যারা রয়েছেন তারা সকলেই চাটুকার। ওদের কবল থেকে বের হয়ে জনতার কাতারে আসুন, তাহলে তা হবে বঙ্গবন্ধুর কন্যার জন্য অত্যন্ত শুভ একটি উদ্যোগ।’ তিনি আরও বলেন, ‘টিভি টক শো বন্ধ করার মধ্যে গণতান্ত্রিক রীতি অনুসরণের কোন আভাস নেই।’
রব উল্লেখ করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি চিকিৎসার জন্যে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনার জন্য আসিনি। তবুও জনজীবনের নিরাপত্তার কথা বলতেই হবে। এখন কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেন না যে, ঘর থেকে বের হবার পর সুস্থমতো আবার ফিরতে পারবেন। জনজীবনে নিরাপত্তা বলতে কিছুই নেই।’ রব অভিযোগ করেন, ‘যুবসমাজকে নষ্ট করা হচ্ছে সুপরিকল্পিতভাবে। শিক্ষাঙ্গনে অস্ত্র, মদ ও গাজা ইত্যাদি ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। ছাত্রদেরকে ‘তেলইজমে’ পরিণত করা হয়েছে। অর্থাৎ ‘ক্ষমতাসীনদের তেল মারো আর মাল কামাও’-এভাবে মেধাহীন করা হচ্ছে বাংলাদেশকে।’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস রচিত হয়নি বলে অভিযোগ করে জাসদ নেতা আ স ম আব্দুর রব বলেছেন, ‘রাষ্ট্রীয় অথবা সামাজিকভাবে সঠিক ইতিহাস আজও তৈরি হয়নি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অথবা স্বাধীনতা সংগ্রামের। যত ইতিহাস হয়েছে সবগুলোতেই একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কথা লেখা হয়েছে। তাহলে বাষট্টিতে সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, কাজী আরিফদের নেতৃত্বে গঠিত নিউক্লিয়াসের ভূমিকা কোথায়?
নিউক্লিয়াসকে অস্বীকার করা হলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতেন কীভাবে?’ রব বলেন, ‘মিথ্যার বেসাতি করে লাভ নেই। সত্য মাটি ফেড়ে বের হবেই।’ ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে এ মিথ্যাচার চলতে থাকলে আমি আশ্চার্য হবো না যে, এক সময় হয়তো বলা হবে যে, বিদেশীরাই আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে’-মন্তব্য করেন রব।
‘একাত্তরের ২ মার্চ স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইস্তেহার পাঠ, ৭ মার্চে রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম’-এসব তাহলে কী’-প্রশ্ন রাখেন রব।
মুুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশীদের স্বীকৃতি প্রদানের প্রতি ইঙ্গিত করে রব বলেন, ‘নিজেরা নিজেদের স্বীকৃতি দিতে পারি না, অথচ বিদেশীদের ঘটা করে অ্যাওয়ার্ড দিচ্ছি। মধুপুরে একটি চার্চের ফাদার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছেন। তাকে সম্মান জানানো হচ্ছে না কেন? ফাদার হলি নামক আরেকজন খ্রিস্টান, যিনি বাংলাদেশে আঙ্গুর চাষ করেছেন, তারও অপরিসীম অবদান রয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে।’ ‘যৌথ বাহিনী এক হাজার বছরেও বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে পারতো না যদি সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির ৯৯ ভাগই মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় না দিতেন। তাই আমি মনে করি সাড়ে ৭ কোটি বাঙালিই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন’-মন্তব্য রবের।
‘বঙ্গবন্ধু, কর্ণেল তাহের, খালেদ মোশারফ, জেনারেল জিয়া, জেনারেল মঞ্জুর নিহত হবার ঘটনা থেকেও আমরা শিক্ষা নিতে পারিনি। এখনও কোন দলের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সকলেরই টার্গেট হচ্ছে ক্ষমতায় গিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটেপুটে খাবার। মগের মুল্লুকে পরিণত করা হয়েছে বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটিকে’-ক্ষোভের সাথে বলেন রব।
‘বাংলাদেশের মানুষের কথা বলার অধিকার নেই। বন্ধ করা হচ্ছে টক শো। টিভি স্টেশনও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রুদ্ধ করা হয়েছে জনগণের রাজনৈতিক অধিকার’-অভিযোগ রবের। ‘মুখ বন্ধ করে রাখার পরিণতি কতটা ভয়াবহ তার সাক্ষী ইতিহাস। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার চারদিকে যারা রয়েছেন, তারা সবাই চাটুকার। চাটুকারদের কথায় বিশ্বাস না করে জনগণের কাতারে আসুন, তা সকলের জন্যেই মঙ্গলের হবে’-পরামর্শ রবের।
প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশের মেধাবিরা বিদেশে এসে গবেষণায় কৃতিত্ব দেখাচ্ছেন। বৃটিশ পার্লামেন্টের মেম্বার হচ্ছেন। মহাকাশে যারা যাচ্ছেন তাদের খাদ্য প্রণালী প্রস্তুত করছেন বাঙালিরা। অথচ এসব মেধাকে নিজ দেশের কল্যাণে ব্যবহারের সুযোগ নেই। রাজনৈতিক কারণে মেধাবিদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়ার এ প্রবণতা রুখতে হবে জাতীয় স্বার্থে-বলেন রব।
একাত্তরের মত আবারো জনগণের ঐক্য দরকার, আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ করতে হবে। যার মধ্য দিয়ে ১৬ কোটি মানুষ বিশ্ব দরবারে উন্নত রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে-মন্তব্য আ স ম রবের।
শনিবার সন্ধ্যায় নিউইয়র্কে লক্ষ্মীপুর জেলা কল্যাণ সমিতি কর্তৃক প্রদত্ত সংবর্ধনা সমাবেশে রবের স্ত্রী বিশ্ব বাঙালি ফাউন্ডেশনের সভানেত্রী তানিয়া রব ছাড়াও উদ্যমী প্রবাসীদের মার্কিন আইটি সেক্টরে কাজ পাইয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে অপরিসীম ভূমিকা পালনকারী ‘পিপল এন টেক ইন্সটিটিউট’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইঞ্জিনিয়ার আবু হানিফও বক্তব্য রাখেন। আয়োজক সংগঠনের সভাপতি তসলিম উদ্দিন খানের সভাপতিত্বে গভীর রাত অবধি চলা এ সমাবেশের সঞ্চালক ছিলেন আশরাফুল হাসান বুলবুল। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মুকিত চৌধুরী, জাসদের প্রবাসী বিষয়ক সম্পাদক মুজিবর রহমান এডভোকেট প্রমুখ। শুরুতে আ স ম রব এবং তানিয়া রবকে প্রবাসীদের পক্ষ থেকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়।
বিডি-প্রতিদিন/০২ আগস্ট, ২০১৫/মাহবুব