ম্যানহাটানে সাইফুল্লো সাইপোভ কর্তৃক সাইকেল আরোহিদের ওপর ট্রাক চালিয়ে ৮ জনকে হত্যার ঘটনার পরদিনই নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যের প্যাটারসন ও এডিসন এলাকায় বেশ কটি মসজিদে হামলার হুমকি এবং হিন্দু-চায়নিজদের তাড়িয়ে দেয়ার দাবিতে টেলিফোন ও পোস্ট-কার্ড বিতরণ করা হয়েছে।
নিউইয়র্ক সিটিতে ৩১ অক্টোবর মঙ্গলবার সন্ত্রাসী হামলার জন্যে অভিযুক্ত সাইপোভ এই প্যাটারসন এলাকার অধিবাসী ছিলেন এবং সেখানকার মসজিদ ওমরে মাঝে মধ্যে নামাজ পড়তেন।
কংগ্রেসমওম্যান এবং ডেমক্র্যাটিক পার্টির জাতীয় কমিটির ভাইস চেয়ার গ্রেস মেং ২ নভেম্বর প্রদত্ত এক বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এহেন ধর্মীয় ও জাতিগত বিদ্বেষমূলক পোস্টারিংসহ নানা অপতৎপরতার সংবাদে। কাউন্সিল অন আমেরিকান ইসলামিক রিলেশন্স-এর নিউজার্সি চ্যাপ্টারের নির্বাহী পরিচালক জেমস সুয়েজ গভীর উদ্বেগের সাথে বলেছেন, ‘এ এলাকার মানুষেরা ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে নিপতিত হয়েছেন। বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা মসজিদে যাতায়াতে ভয় পাচ্ছেন। কারণ, আশপাশের ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা নানাভাবে তাদের ভয় দেখাচ্ছে।’
প্যাটারসনের গ্যাটি এভিনিউতে অবস্থিত ইসলামিক সেন্টার অব প্যাসেইক কাউন্টি পরিচালিত মসজিদ ওমরে টেলিফোন করেই শুধু হুমকির ঘটনা ঘটেনি, ঢিল ছুঁড়েও ভয় দেখানো হয়েছে মুসল্লিগণকে। মসজিদের ফেসবুক পেইজেও ঘৃণামূলক মন্তব্য জুড়ে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, ‘এই মসজিদে সন্ত্রাসে উস্কে দেয়ার শিক্ষা দেয়া হচ্ছে এবং মানুষকে জানুয়ারে পরিণত করা হচ্ছে। এমন প্রতিষ্ঠান এলাকাবাসী দেখতে চায় না’।
জুমআর নামাজে জড়ো হওয়া মুসল্লিসহ আশপাশের লোকজনের উদ্দেশ্যে বক্তব্যকালে রাজা সালেন বলেন, ‘একজনের একটি অপকর্মের জন্যে সকলকে দোষারোপ করা সমীচিন নয়। সকল বর্ণ, জাতি এবং ধর্মের মানুষের মধ্যেই দুয়েকজন মন্দ মানুষ রয়েছে। তাই বলে কি আমরা ঐ মন্দ মানুষটির দুষ্কর্মের দায় ঐ ধর্মাবলম্বী সকলের ওপর বর্তাবো?’ তাহলে তো সামাজিক সম্প্রীতি অটুট রাখা কঠিন হয়ে পড়বে-মন্তব্য রাজার। এই মসজিদের প্রেসিডেন্ট ওমর আওয়াদ বলেছেন, ‘মঙ্গলবার ম্যানহাটানে সাইকেলের লেনে পিকআপ ট্রাক চালিয়ে ৮ জনকে হত্যা এবং ১২জনকে আহত করার পরদিন বুধবার এবং বৃহস্পতিবার কমপক্ষে ৮ বার টেলিফোনে হুমকি দেয়া হয়েছে। বলা হয়, ‘তোমাদেরকেও আমরা মেরে ফেলবো। তোমাদের মসজিদ পুড়িয়ে দেব’।
মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে এহেন হুমকি-ধমকির তথ্য স্থানীয় পুলিশ এবং হোমল্যান্ড সিকিউরিটি মন্ত্রীকে অবহিত করা হয়েছে বলে উল্লেখ করে ওমর আওয়াদ বলেন, ‘এর আগেও হুমকি পেয়েছি কিন্তু এবারের মত ভয়ংকরভাবে নয়। এ অবস্থায় মুসল্লিরা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছেন।’
এদিকে ২ নভেম্বর বৃহস্পতিবার প্রদত্ত এক বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ডেমক্র্যাটিক পার্টির জাতীয় কমিটির ভাইস চেয়ার এবং নিউইয়র্ক থেকে নির্বাচিত প্রথম এশিয়ান কংগ্রেসওম্যান গ্রেস মেং। তিনি অভিযোগ করেছেন, ‘নিউজার্সির একটি স্কুল বোর্ডের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন চায়নিজ-আমেরিকান জেরি শি এবং ভারতীয়-আমেরিকান ফাল্গুনি পাটেল। এ দু’জনকে আমেরিকার শত্রু হিসেবে অভিহিত করে পোস্টার বিতরণ করা হচ্ছে। চায়নিজ এবং আমেরিকানরা নাকি নিউজার্সির এই এডিসন সিটির নেতৃত্ব দখল করছে। তাই এ দুটি সম্প্রদায়ের লোকজনকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা হউক।’ বিবৃতিতে গ্রেস মেং একটি পোস্টারের কপিও জুড়ে দিয়েছেন। গ্রেস মেং তার বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন, ‘বহু বর্ণ, ধর্ম এবং জাতির মানুষেরাই হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শক্তি এবং এই মূল্যবোধেই বিশ্বে শ্রেষ্ঠ দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে আমেরিকা। এখানকার গণতন্ত্রে কিংবা সমাজজীবনে এ ধরনের হিংসা-বিদ্বেষের স্থান নেই। নিউজার্সির নীতি-আদর্শেরও পরিপন্থি এমন আচরণ।’ মেং, উল্লেখ করেছেন নিউজার্সির প্রতি ৫ জন অধিবাসীর একজনই হলেন ইমিগ্র্যান্ট, এবং এই এডিসন সিটির প্রায় অর্ধেকই এশিয়ান। তারা কঠোর পরিশ্রমী ব্যবসায়ী, ট্যাক্সপ্রদানকারি, শিক্ষক এবং মেধাবি সন্তান লালন-পালনকারি মা। তারা সকলেই সম্প্রীতির বন্ধনে দিনাতিপাত করছেন এবং আমেরিকাকে অগ্রগতির শিখরে উঠাতে নিরন্তরভাবে সচেষ্ট রয়েছেন। এমনি অবস্থায় এমন ধরনের বর্ণবিদ্বেষী প্রচারণা সত্যি দু:খজনক এবং লজ্জাস্কর বৈকি। এহেন কর্মকান্ডে প্রকৃত অর্থে সামাজিক শান্তি হুমকির মধ্যে ঠেলে দেয়ার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে, যা সমাজের সিংহভাগ মানুষই পছন্দ করেন না।’
‘আমি আশা করছি যে, এডিসনের ভালো মানুষেরা এহেন আচরণকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করবেন এবং প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি এমন বিদ্বেষী আচরণে লিপ্তদের চিহ্নিত করার জন্যে’-উল্লেখ করেছেন গ্রেস মেং।
এদিকে, স্থানীয় প্রশাসন থেকে বলা হয়েছে যে, এডিসন স্কুল বোর্ডের নির্বাচনী প্রচারণায় এমন হিংসাত্মক পোস্টার প্রকাশ কিংবা একটি জাতিগোষ্ঠিকে আক্রমণ করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাদের তাড়িয়ে দেয়ার মত কথা বলার কোন সুযোগ/অধিকার আছে কিনা। বিদ্যমান আইন লংঘিত হয়ে থাকলে অবশ্যই দায়ীদের বিচারে সোপর্দ করা হবে।
ঐ পোস্টারে লেখা হয়েছে যে, ‘চায়নিজ আর ইন্ডিয়ানরা আমাদের শহর দখল করে নিচ্ছে। তারা চায়নিজ স্কুল, ইন্ডিয়ান স্কুল গড়ছে। দখল করছে ক্রিকেট খেলার মাঠ। অনেক হয়েছে। আর নয়। ঐ পোস্টারে জেরি শি এবং ফাল্গুনি পাটেলের ছবিও দেয়া হয়েছে। তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অবিলম্বে বহিস্কারের দাবিও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম বৃহত্তম এই পৌর সভার নাগরিকদের অর্ধেকেরও বেশী হলেন এশিয়ান।
সামনের নির্বাচনে এডিসন সিটির ডেমক্র্যাট প্রার্থী থমাস ল্যাঙ্কি এবং রিপাবলিকান প্রার্থী কীথ হ্যান পৃথক পৃথকভাবে এহেন প্রচারণার নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছেন। নিউজার্সি থেকে ডেমক্র্যাটিক পার্টির ইউএস সিনেটর রবার্ট মেনেন্ডেজ এক টুইট বার্তায় উল্লেখ করেছেন, ‘এডিসন সিটিকে মহান করেছে বহুজাতিক মানুষেরা। সাথে সাথে তারা নিউজার্সিকেও মহিমান্বিত করেছেন।’ সর্বশেষ সংবাদে জানা গেছে, হিন্দু-মুসলিম-চায়নিজ সম্পদায়ের লোকজনকে আক্রমণাত্মক এহেন ঘটনাবলীর ব্যাপারে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা মাঠে নেমেছে।
বিডি-প্রতিদিন/ সালাহ উদ্দীন