বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে বিবৃতির মাধ্যমে নিউইয়র্ক মহানগর আওয়ামী লীগের কর্মকর্তাকে বহিষ্কারের ঘটনায় আমেরিকায় রাজনৈতিক সচেতন মহলে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই চলছে এমন বিবৃতি এবং পাল্টা বক্তব্যের ঘটনাবলী। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, ১১ মাস আগে যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগে বাধ্য হওয়া নিউইয়র্ক মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নূরনবী কমান্ডারকে কমপক্ষে ১০ বছর অপেক্ষা করতে হবে বৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরতে। এমন বাস্তবতায় বাধ্য হয়েই নভেম্বরের ২০ তারিখে নিউইয়র্ক মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটি এক সভায় মিলিত হয়ে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জাকারিয়া চৌধুরীকে পূর্ণ সভাপতির দায়িত্ব অর্পণ করে। এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় যে, নূরনবী কমান্ডার অভিবাসনের প্রক্রিয়ায় যদি পরবর্তী সম্মেলনের আগে নিউইয়র্কে ফিরতে সক্ষম হন, তাহলে তাকে সভাপতির দায়িত্ব ফিরিয়ে দিতে কেউ কুণ্ঠাবোধ করবে না। ৭৪ বছর বয়সী নূরনবী কমান্ডার দীর্ঘ ৩০ বছর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটিতে বসবাস করলেও গ্রীনকার্ড পাননি। শুধু তাই নয়, ১৫/১৬ বছর আগে থেকেই তার বিরুদ্ধে বহিষ্কারের নির্দেশ জারি ছিল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কঠোর ইমিগ্রেশন নীতির কারণে আরো অনেকের মত এই নূরনবীও স্বেচ্ছায় যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করেছেন। অথচ এমন নিষ্ঠুর সত্য গোপন করে গত ২৬ নভেম্বর ঢাকায় গণভবনে গিয়ে এই নূরনবী এবং নিউইয়র্ক মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (যিনি বছরের অধিকাংশ সময়ই ঢাকায় থাকেন) ইমদাদ চৌধুরী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করেন। তারা উভয়ে জাকারিয়া চৌধুরীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেন। সে সময় সভাপতি শেখ হাসিনা তাদের কী নির্দেশ দিয়েছেন, সেটি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব না হলেও গণভবন থেকে বের হয়েই এই দু’জন একটি চিঠি পাঠিয়েছেন জাকারিয়া চৌধুরীকে বহিষ্কারের।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘মাননীয় সভাপতি ও জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সংগঠনের নীতি, আদর্শ, চেতনা, মূলবোধবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত থাকা এবং সাংগঠনিক শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে আপনাকে নিউইয়র্ক মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদ থেকে বহিষ্কার করা হলো’।
প্রবাসে বৃহত্তম এই রাজনৈতিক দলের এমন কর্মকাণ্ডে হাস্যরস তৈরি হয়েছে। নিউইয়র্ক মহানগর আওয়ামী লীগের অন্যতম সহ-সভাপতি মাসুদ হোসেন সিরাজি এ সংবাদদাতাকে বলেন, ‘যে ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী ১০ বছর পর্যন্ত বৈধ ভিসায় আর ফিরতে পারবেন না, তেমন ব্যক্তির এমন ফরমান জারির ফলে সাংগঠনিক শৃঙ্খলাবোধে বিশ্বাসীরা হতবাক হয়েছি। জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে নিজের অবস্থানের তথ্য গোপন করে নূরনবী কমান্ডারের সাথে দলের সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ চৌধুরীও নেতা-কর্মীদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হলেন।’
উল্লেখ্য, নূরনবী কমান্ডার স্থায়ীভাবে যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগের সময় এ বছরের ১৪ জানুয়ারি এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি জাকারিয়া চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে সাংগঠনিক সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনার কথা জানান। সে অনুযায়ী সবকিছু চলার মধ্যেই ইমদাদ চৌধুরী সম্প্রতি ঢাকায় গিয়ে নূরনবী কমান্ডারকে সাথে নিয়ে নিউইয়র্ক মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সভা দেখিয়ে বেশ কয়েকজনকে পদোন্নতি প্রদানের প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করেন গত মাসের প্রথমার্ধে। এরপরই কার্যকরী কমিটির সকলে ক্ষেপে যান এবং ২০ নভেম্বর জ্যাকসন হাইটসে টক অব টাউন রেস্টুরেন্টে বৈঠকে বসেন।
উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সভাপতি জাকারিয়া চৌধুরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি ২ ডিসেম্বর শনিবার এ সংবাদদাতাকে জানান, ‘সংগঠনের পদ ব্যবহার করে ঢাকায় মন্ত্রীপাড়ায় বিভিন্ন তদবির বাণিজ্য চালাতে চান অব্যাহিতপ্রাপ্ত (সাংগঠনিক নিয়মে) সভাপতি নূরনবী কমান্ডার। এ অভিপ্রায়েই জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে গিয়ে আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়েছেন বয়োবৃদ্ধ এই মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিক। তাকে আমি শ্রদ্ধা করি সব সময়। কিন্তু সাংগঠনিক রীতি অনুযায়ী তাকে অব্যাহতি প্রদানে বাধ্য হয়েছি। কারণ, তার পক্ষে নিউইয়র্কে ফেরা প্রায় অসম্ভব।’
‘আমি নিশ্চিত, সভাপতি শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাতের সময় নূরনবী কমান্ডার নিশ্চয়ই নিজের অভিবাসন মর্যাদার সংকটের তথ্য প্রকাশ করেননি। কিংবা এমন কথাও তাঁকে জানাননি যে, তার পক্ষে সহসা নিউইয়র্কে ফেরা সম্ভব নয়’
জাকারিয়া চৌধুরী আরও বলেছেন, ‘২ অক্টোবর ভার্জিনিয়াতে সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ৯ মিনিটের বৈঠকের সময় আমি নিউইয়র্কে জামায়াত-শিবির এবং ফ্রিডম পার্টির অর্থে পরিচালিত একটি মিডিয়া কর্তৃক বঙ্গবন্ধু পরিবারের ইমেজ বিনষ্টে লাগাতার সংবাদ ও কথিত ‘টক শো’র তথ্য উল্লেখ করি। অথচ ওই মিডিয়া বর্জনের পরিবর্তে আওয়ামী লীগের কেউ কেউ উল্টো পৃষ্টপোষকতা দিচ্ছেন বলে উল্লেখ করেছি। সেটিই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, ওই মিডিয়ার প্রধান সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেছেন।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, সে সময় ঢাকায় বৈঠক হয় ওই মিডিয়ার প্রধানের সাথে নূরনবী কমান্ডার, ইমদাদ চৌধুরীর। ওই বৈঠকে জামায়াত-শিবিরের লোকজনও ছিলো। তারপরই শুরু হয়েছে গোয়েবলসীয় কায়দায় ফরমান জারির ঘটনা।’
এদিকে, সভাপতি শেখ হাসিনার উদ্ধৃতি দিয়ে জাকারিয়া চৌধুরীকে সংগঠন থেকে বহিষ্কারের যে তথ্য প্রচার করা হয়েছে তার কোন সত্যতা গণভবনের কোন মহল থেকেই নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এমনকি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ও শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারি ড. আব্দুস সোবহান গোলাপের কাছেও এ ব্যাপারে দাপ্তরিক কোন নির্দেশ ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত পৌঁছেনি (যদি তা সত্য হয়) বলে জানা গেছে। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমানও ১ ডিসেম্বর ঢাকায় গেছেন। তিনিও ওই বহিষ্কারাদেশের সত্যতা উদঘাটনের চেষ্টা করছেন বলে সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে।
সহসা যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার সম্ভাবনা একেবারেই না থাকা সত্বেও কেন এমন অসাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় লিপ্ত হয়েছেন তা জানার জন্যে বাংলাদেশে নূরনবী কমান্ডারের সেলফোনে চেষ্টা করেও তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
উল্লেখ্য, নিউইয়র্ক মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটির অনুমোদনের সময় সভাপতি শেখ হাসিনা এর মেয়াদ নির্ধারণ করে দিয়েছেন ৩ বছর। এখন চলছে ৬ বছর অর্থাৎ ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এ কমিটি বহাল রয়েছে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমতি পেলে যে কোন সময় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে নতুন কমিটি হবে। আরও উল্লেখ্য, এই সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অধিভুক্ত শাখা নয়, এটিকে ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনের মর্যাদা দিয়ে তা সরাসরি পরিচালিত হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে।
বিডি-প্রতিদিন/০৩ ডিসেম্বর, ২০১৭/মাহবুব