বিজয় দিবসের সমাবেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির প্রতিবাদে প্রায় সকলেই অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন। এক পর্যায়ে অনুষ্ঠানের উপস্থাপকও মঞ্চ ত্যাগ করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে আয়োজকরা প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনার পর কণ্ঠযোদ্ধা রথীন্দ্রনাথ রায় সঙ্গীত পরিবেশনে সম্মত হলেও পুরো মিলনায়তনের ৯০ শতাংশই ছিল ফাঁকা।
এমন পরিস্থিতির অবতারণা হয় রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি সংলগ্ন ভার্জিনিয়ায় একটি অডিটরিয়ামে শনিবার (২১ ডিসেম্বর) রাতে বাগডিসি (বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব গ্রেটার ওয়াশিংটন ডিসি)’র উদ্যোগে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে।
বিজয় দিবস তথা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসভিত্তিক একটি অডিও বাজানোর সময় জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন বলে ধ্বনিত হওয়ায় অধিকাংশ দর্শক-শ্রোতাই প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। এর উপস্থাপনায় ছিলেন ভয়েস অব আমেরিকার সাংবাদিক শতরূপা বড়ুয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শামীম চৌধুরী।
বিজয় দিবসভিত্তিক এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন ওয়াশিংটন ডিসি আওয়ামী লীগের নেতা মোহাম্মদ আলমগীর। দর্শক-শ্রোতারা প্রতিবাদে ফেটে পড়লেও তিনি আসনেই ছিলেন নির্বিকার এবং শেষ পর্যন্ত বসেই ছিলেন।
ইতিহাস বিকৃতির অবতারণা হবার সাথে সাথে শতরূপা বড়ুয়া এহেন আচরণের নিন্দা ও প্রতিবাদে মঞ্চ ত্যাগ করেন। এ প্রসঙ্গে ফেসবুকে তিনি এক পোস্টে উল্লেখ করেছেন, ‘ফ্লোরিডা থেকে মেরিল্যান্ডে এসেছি প্রায় সাত বছর হতে চললো। গত কয়েক বছরে, বৃহত্তর ডি সি এলাকায় অসংখ্য অনুষ্ঠানে আমার এম সি করার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু, আজ (২১ ডিসেম্বর, শনিবার) রাতে, প্রবাসী বাংলাদেশিদের একটি সংগঠন আয়োজিত অনুষ্ঠানে, যা ঘটলো, এমন একটি অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে তা কোনোদিন কল্পনা করিনি।
তিনি লিখেছেন, ‘আজকের অনুষ্ঠানে একটি অডিও বাজানো হয়, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃত করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। স্বাধীনতার স্বপক্ষের আদর্শের অনুসারী হিসেবে, বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এ ধরণের বিকৃতির ঘৃণ্য অপচেষ্টা, আমাকে স্তম্ভিত করেছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে আমি অনুষ্ঠানের বাকি অংশ উপস্থাপনায় অস্বীকৃতি জানিয়ে চলে আসি।’
শতরূপা বলেছেন, ‘বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির এ ধরনের ধৃষ্টতার আমি তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছি এবং আয়োজকদের পক্ষ থেকে এ-ব্যাপারে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি।’
এ অনুষ্ঠানে ছিলেন এবং প্রতিবাদ জানান লেখক-সাংবাদিক-মুক্তিযোদ্ধা হারুন চৌধুরী। তিনি এ সংবাদদাতাকে বলেন, ‘বাগডিসির এ অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট এবং স্বাধীনতার ঘোষক হিসাবে প্রচার করা হয়। এতে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষের শক্তির মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। প্রতিবাদের মুখে বিজয় দিবসের অনুঠান পণ্ড হয়ে যায়।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির ধৃষ্ঠতা প্রসঙ্গে ওই অনুষ্ঠানের মূল শিল্পী কণ্ঠযোদ্ধা রথীন্দ্রনাথ রায় এ সংবাদদাতাকে বলেন, ‘সুপরিকল্পিতভাবে ইতিহাস বিকৃত করার মত পরিক্রমায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন সকলে। অধিকাংশ মানুষই অনুষ্ঠান বর্জন করেছেন। এ অবস্থায় আয়োজকরা প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনার পর অনুষ্ঠানে আমি সঙ্গীত পরিবেশন করেছি।
বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে এমন ঘটনার সংবাদ জানাজানি হবার পর সমগ্র কমিউনিটিতে ক্ষোভের সঞ্চার ঘটেছে। কারণ, হোস্টদের প্রায় সকলেই আওয়ামী ঘরানার লোক বলে দাবি করা হয়। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের যুক্তরাষ্ট্র শাখার সভাপতি ড. খন্দকার মনসুর (তিনি ওই অনুষ্ঠানে ছিলেন না) রবিবার (২২ ডিসেম্বর) এ সংবাদদাতাকে জানান, ‘যারা এমন অপকর্মের সাথে জড়িত তাদেরকে চিহ্নিত করতে হবে। ইতিমধ্যেই বাগডিসি কর্তৃপক্ষ আমাকে নিশ্চিত করেছেন যে, কার্যকরী কমিটির বৈঠক ডেকে সংশ্লিষ্টদের বহিষ্কার করা হবে। সামাজিকভাবে ওদেরকে চিহ্নিত করা হবে।’
বাগডিসির বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃতির তীব্র নিন্দা, ক্ষোভ ও প্রতিবাদ করেন আরিফুর স্বপন, ড. আরিফুর রহমান , ড. সুয়েব চৌধুরী, মোস্তাফিজুর রহমান ও আলাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকেই।
এদিকে, ইতিহাস বিকৃতির ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে এক বিবৃতি দিয়েছে সার্বজনীন মুজিববর্ষ উদযাপন পরিষদ ওয়াশিংটন ডিসি। এ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে বাগডিসিকে জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে ঘটনার সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন- মুজিববর্ষ উদযাপন পরিষদ ওয়াশিংটন ডিসির আহ্বায়ক শিব্বীর আহমেদ, সদস্য সচিব জি আই রাসেল, সাংস্কৃতিক সম্পাদক জীবক বড়ুয়া, যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ, আকতার হোসাইন, মুজিবুর রহমান খান, জুয়েল বড়ুয়া, আবুল শিকদার, যুগ্ম সচিব দেওয়ান আলী বিজয়, হারুনুর রাশিদ, জাহিদ হোসেন, সমন্বয়কারী আমান উল্লা, আলতাফ হোসাইন, প্রচার সম্পাদক মীর রফিক, উপদেষ্টা সাদেক এম খান, আলাউদ্দীন আহমেদ, মোহাম্মদ সিরাজুল হক প্রমুখ।
বিডি প্রতিদিন/এনায়েত করিম