বিকালে স্কুল থেকে এসে খাবার খেয়ে ফসলের মাঠের দিকে ছুটে গেল রাতুল।
পড়ন্ত বিকেল। তাপহীন সূর্যের আলো। মনোরম চৈত্রালী বায়ু। চারদিকে সবুজ ফসলের মাঠ। মাঠের বুক চিড়ে বয়ে গেছে খাল। খালপাড়ের সরু আইল দিয়ে হেঁটে চলছে সে। উদ্দেশ্য শুকনো ফসলের মাঠে, খোলা আকাশের নিচে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া। স্কুল ছুটির আগেই বন্ধুদের বলেছিল ‘আজ বিকালে
মাঠের মাঝে, সবুজের গালিচায় বসে আড্ডা দেওয়ার জন্য সবাই খালপাড়ে চলে এসো’।
রাতুল সপ্তম শ্রেণির নম্বর ওয়ান স্টুডেন্ট। পড়ালেখার পাশাপাশি চিন্তা-চেতনায়ও অনন্য। সেরা ছাত্র হওয়ার পরও তার মাঝে কোনো অহংকার নেই। সবার সঙ্গে মিশে। হাসিমুখে কথা বলে। অসহায় ছাত্রদের জন্য সামর্থ্য
অনুসারে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। কখনো কোনো সহপাঠী অসুস্থ হলে বাড়ি
গিয়ে দেখে আসে। এজন্য স্কুলের স্যার থেকে নিয়ে পাড়া মুরুব্বিরাও দারুণ ভালোবাসে তাকে। বন্ধুরাও ফেলতে পারে না তার কথা। তার ডাকে সাড়া দিয়ে বন্ধুরাও চলে এলো সবুজের মাঠে।
প্রকৃতির রূপ ও বৈচিত্র্য বার্তা দিচ্ছে নববর্ষের। গাছের ঝরে পড়া পাতার স্থলে নতুন পাতা গজিয়েছে। গাছের ডালে, ফসলের মাঠে সবুজের শামিয়ানা। পাখিদের কিচিরমিচির আর মেঘের গর্জনে শোনা যাচ্ছে নববর্ষের গান। দোকানিদের হালখাতার নিমন্ত্রণপত্র দেখে মনে হচ্ছে এই বুঝি চলে এলো ‘পয়লা বৈশাখ’।
রাতুল আসার আগেই তার বন্ধুরা চলে এলো। সে একটু দেরি হলেও বন্ধুদের মাঝে এসে উপস্থিত হলো। কুশল বিনিময় করে রাতুল তার বন্ধুদের বলল, ‘দেখতেই তো পাচ্ছ, প্রকৃতির বৈশাখী সাজ। আর কটা দিন পরেই আমরা নববর্ষ উদ্যাপন করব। বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে মেতে উঠব। পান্তা-ইলিশ খাব। দলবেঁধে মেলায় যাব। মাটির তৈরি পুতুল, ঘোড়া, ষাঁড় ইত্যাদি কিনব। মুড়ি-মুড়কি খাব। ঘুড়ি উড়াব। বিকাল বেলা বাঁশি বাজাতে বাজাতে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে বাড়ি ফিরব। আমরা অনেক মজা করব তাই না?
বন্ধুরা বলল অনেক মজা হবে।’
এবার রাতুল বলল, কিন্তু আমাদের পাশের গাঁয়ের বাস্তুহারা পল্লীর শিশুদের কোনো খোঁজখবর কি আমরা নিয়েছি? হয়তোবা তারা পান্তা পাবে কিন্তু ইলিশ পাবে না। কাঁচামরিচই ইলিশের মতো করে খাবে। তবে সেটা পয়লা বৈশাখ হিসেবে খাবে না। কেননা পান্তা-মরিচ ওরা প্রতিদিন সকালেই খায়। ওরা হয়তো মেলায় আসবে কিন্তু টাকা না থাকার কারণে কোনো কিছুই কিনতে পারবে না। শূন্য হাতে, ভগ্ন হৃদয়ে ফিরে যাবে। রাতুল কথাগুলো শুনে বন্ধুরা সবাই আপ্লুত হলো। ওরা জানে রাতুল সবসময়
সমাজের অবহেলিত শিশুদের কথা ভাবে। মাঝে মাঝে সবার অগোচরে বাস্তুহারা বস্তির শিক্ষা বঞ্চিত শিশুদের ‘অ, আ, শেখায়।’
অতপর রাতুল বলল : আমরা কি ওদের মুখে হাসি ফোটাতে পারি না?
বন্ধুরা বলল অবশ্যই পারব ওদের মুখে হাসি ফোটাতে।
এবার রাতুল তার প্ল্যান খুলে বলল।
যে, আমরা নববর্ষের দিন সকালে বাস্তুহারাতে যাব। বাস্তুহারা পল্লী থেকে শিশুদের নিয়ে মেলায় যাব। তাদের পছন্দ মতো খেলনা কিনে দেব। মুড়ি-মুড়কি খাওয়াব। সবাইকে নিয়ে ঘুড়ি উড়াব। বিকাল বেলা বাঁশি বাজাতে বাজাতে বাস্তুহারাতে ওদের দিয়ে আসব।
এক বন্ধু বলে উঠল এতে অনেক টাকা লাগবে। কিন্তু টাকা কোথায় পাব?
রাতুল বলল : টাকার জন্য ভাবিস না। টাকার ব্যবস্থা হবেই।
কিন্তু কীভাবে? প্রশ্ন করল বন্ধুরা।
রাতুল জবাব দিল। শোন আরও বেশকিছু দিন বাকি আছে পহেলা বৈশাখের। সুতরাং আমরা নাস্তা না খেয়ে, নাস্তার টাকাটা মাটির একটা ব্যাংকে জমা রাখব। এ ছাড়াও হেড স্যার, ডাক্তার আংকেলকে আমাদের পরিকল্পনার কথা বললে অনেক খুশি হবেন। টাকা-পয়সা দিয়ে এগিয়ে আসবেন। তখন আমরা আমাদের উদ্দেশ্য সফল হতে পারব। ফোটাতে পারব অসহায় শিশুদের মুখে হাসি। এরই মাঝে এক বন্ধু লাফিয়ে উঠে বলল : দোস্ত আমাদের ব্যাংকটার নাম হবে ‘বৈশাখী ব্যাংক’।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে বাড়ির পথ
ধরল সবে...।