কোরআনের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহপাক মানুষের না শোকরি ও অকৃতজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। বলেছেন যে, তোমাদের আমি লাখো-কোটি নিয়ামত দান করেছি। কিন্তু আশ্চর্য যে, তোমরা আমার না শোকরি কর। তোমাদের মধ্যে যে কৃতজ্ঞতার স্বভাব ও যোগ্যতা নেই তা নয়। কেউ যদি তোমাকে দুই-একবার জিজ্ঞাসা করে, কেমন আছেন? তাহলে তার প্রতি তুমি কৃতজ্ঞ হও। তার প্রশংসা করে বল যে, লোকটা খুব ভালো! মানুষের ভালো-মন্দের খবরা-খবর নেয়। তেমনিভাবে কেউ একবেলা তোমার মেহমানদারি করলে তার প্রতিও তুমি কৃতজ্ঞ হও। যদি তোমার দৃষ্টিশক্তিতে ত্রুটি দেখা দেয় আর ডাক্তার তোমাকে চিকিৎসা করে চশমা দেয়, তাহলে ডাক্তারকে দেখলেই তুমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হও। বোঝা গেল, তোমার মনমানসিকতা ও স্বভাবে শুকরিয়া- কৃতজ্ঞতা বিদ্যমান। যে মুখে মানুষের কৃতজ্ঞতা আদায় কর, সে মুখের বাকশক্তি আমারই দেওয়া। তথাপি আমার কৃতজ্ঞতা আদায় কর না।
'নিশ্চয় অধিকাংশ মানুষ অকৃতজ্ঞ।' আর যা-ও একটু কৃতজ্ঞতা কর, তাও মুখে মুখে, কাজের বেলায় নেই! যেমন এক লাখ টাকা হাতে আসলে বলে আল্লাহ আমাকে এক লাখ টাকা দিয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ! কিন্তু এক লাখ টাকা থেকে কয়েক হাজার টাকা গরিব-মিসকিনদের দান করে দেবে এটা মনে চায় না। তাই বলা হয়েছে মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ। আল্লাহ নির্দেশ করতে পারবেন, অর্থাৎ আমি তোমাকে নবী বানাচ্ছি, সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য শ্রেষ্ঠ নবী বানাচ্ছি। সুতরাং তুমি আমার শুকরিয়া আদায় কর, কৃতজ্ঞ হও এবং মানুষের জন্য আদর্শ বা নিদর্শন হয়ে থাক। কিন্তু আল্লাহতায়ালা নবীকে এই নির্দেশও করলেন না।
এভাবে চিন্তা করলে বহু বিষয় ছিল যে সম্পর্কে আল্লাহপাক নির্দেশ করতে পারতেন, যা কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় নির্দেশ রয়েছে। এ নির্দেশগুলোর মধ্যে কতগুলো ফরজ, কতগুলো ওয়াজিব। যে কোনো একটা ফরজ সম্পর্কে আল্লাহ রসুলকে নির্দেশ করতে পারতেন। তিনি নির্দেশ করতে পারতেন যে, তুমি এতিম। এতিম হিসেবে তোমাকে লালন-পালন করার পর আজ তোমাকে নবী বানাচ্ছি। সুতরাং এতিমদের দয়া করা, তাদের প্রতি সহনশীল হওয়া অত্যন্ত বড় একটি ইবাদত। হাদিসে এসেছে, যার ঘরে এতিম রয়েছে আর সে এতিমের হক আদায় করে, সে বুঝে নিক জান্নাতের ফয়সালা তার জন্য হয়ে গেছে। কত বড় গুরুত্বপূর্ণ আমল! সুতরাং আল্লাহ বলতে পারতেন এতিমদের প্রতি খেয়াল রাখবে। কিন্তু এসব নির্দেশ ও হুকুম না দিয়ে আল্লাহপাক সর্বপ্রথম নির্দেশ করলেন জ্ঞান অন্বেষণ কর। জ্ঞান শেখ। কোন জ্ঞান? রেসালাতের জ্ঞান, খোদায়ী জ্ঞান। যে জ্ঞানের সম্পর্ক সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে। শুধু বস্তুভিত্তিক জ্ঞান নয়।
সূর্যের আলোকে কার্যকরী করতে হলে যেমন চোখের দৃষ্টিশক্তি দরকার, তদ্রূপ চোখের দৃষ্টি কার্যকর করতে হলে সূর্যের আলো দরকার। এমনিভাবে বস্তুভিত্তিক জ্ঞানকে কার্যকরী করতে হলে অদৃশ্য তথ্য খোদায়ী জ্ঞানের প্রয়োজন। আবার খোদায়ী জ্ঞানকে বাস্তবায়িত করতে হলে বস্তু জ্ঞানেরও প্রয়োজন। তাই আল্লাহপাক আদেশ করেছেন, 'পড়ো, জ্ঞান অর্জন করো।' জ্ঞান অর্জনের এই নির্দেশের পেছনে কী তাৎপর্য, কী রহস্য, এ যুগের মানুষকে তা আর বুঝানোর প্রয়োজন নেই। আজকের পৃথিবীতে বিজাতিরা তাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি-কালচার সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে প্রচার-প্রসার করার জন্য তাদের সর্বশক্তি ব্যয় করছে। কারণ তারা বোঝে যে, যতদিন পর্যন্ত মানুষের জ্ঞান না হয়, ততদিন পর্যন্ত সে তার কর্মই স্থির করতে পারে না।
লেখক : খতিব, গুলশান সেন্ট্রাল জামে মসজিদ, ঢাকা।