কখনও কখনও মানুষের হৃৎপিণ্ডে জন্মগত কিছু ত্রুটি থাকে। যেমন: একটি শিশু হয়তো হৃৎপিণ্ডে ছিদ্র নিয়ে জন্মায়। তারপর তার সাধারণ জীবন-যাপন করা হয় না। আর এই ত্রুটির চিকিৎসা একদিকে খরচসাপেক্ষ ব্যাপার, অপরদিকে ঝুঁকিপূর্ণ। আচ্ছা, যদি এই ছিদ্র আঠা দিয়ে বন্ধ করা যায়, তাহলে কেমন হয়? অনেকেই নিশ্চয়ই কথাটা শুনে হাসছেন। কিন্তু এটা এখন আর অসম্ভব নয়। সম্প্রতি জেফ্রি কার্প নামের এক গবেষক হৃৎপিণ্ডের ত্রুটি ঠিক করতে উদ্ভাবন করেছেন এক ধরনের আঠা যা হৃৎপিণ্ডের ভেতরেও কাজ করবে।
তবে হৃৎপিণ্ডের ভেতরে আঠা ব্যবহারের একটা সমস্যা আছে। এই আঠা এমন হতে হবে যেটা বায়োডিগ্রেডেবল অর্থাৎ শরীরের সঙ্গে একসময় মিশে যাবে। হতে হবে শরীরের ভেতরে ব্যবহারের জন্য নিরাপদ। একটু নমনীয় হতে হবে একে, যাতে বেশ কিছুটা টান সহ্য করতে পারে। আর তার ওপরে এমন এক পেশী ধরে রাখতে হবে একে যা সারাক্ষণ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সাধারণ আঠা এক্ষেত্রে কাজ করবে না, সেটা বোঝাই যায়। কার্যকরী একটি সার্জিক্যাল গ্লু তৈরির প্রচেষ্টা চলে আসছে অনেকদিন ধরেই। সেটা করতেই সক্ষম হয়েছেন জেফ্রি কার্প।
প্রায় এক দশক আগে এক ধরনের বায়োডিগ্রেডেবল পলিমান নিয়ে কাজ করছিলেন কার্প। তিনি এর সাহায্য দুই টুকরো কাঁচজোড়া লাগাতে সক্ষম হন। কিন্তু এরপরে অন্য একটি গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি, বেমালুম ভুলে যান এই পলিমারের কথা। পড়ে বস্টন চিল্ড্রেন'স হসপিটালের সার্জন পেড্রো ডেল নিডোর সঙ্গে দেখা হয় তার। তিনি বাচ্চাদের হৃৎপিণ্ডের ফুটো বন্ধ করার একটা ভালো উপায় খুঁজছিলেন। তখন সেই পুরনো পলিমারের কথা মনে করেন কার্প। ডেল নিডো এবং আরও কিছু সার্জনের সাথে মিলে তিনি ওই পলিমারকে আরও উন্নত করার চেষ্টা করেন। সম্প্রতি সেই আঠা পরীক্ষা করে দেখা হয় জীবন্ত ইদুর এবং শুকরের ওপর।
ল্যাবরেটরিতে ইদুরের হৃৎপিণ্ডের ফুটো এবং শুকরের ধমনীর ক্ষত মেরামত করতে এই আঠা ব্যবহার করা হয়। শুধু তাই নয়, অন্য একরকম পদার্থ থেকে তৈরি করা একটি 'প্যাচ' বা 'তালি' দিয়ে হৃৎপিণ্ডের ভেতরের ফুটো মেরামতের কাজেও এই আঠা কাজ করে ঠিকভাবেই। এমনকি একটি ইঞ্জেকশন দিয়ে ওই শুকরের হৃৎস্পন্দন মিনিটে ১৯০-এ উঠিয়ে দেবার পরেও ওই আঠা জায়গামত থাকে। হৃৎপিণ্ডে এমন ত্রুটি থাকার কারণে সাধারণত অপারশনের পরেও রোগীরা খুব ভারী কোনও ব্যায়াম করতে পারেন না। তাদের হৃৎস্পন্দনের মাত্রা কম রাখা লাগে। কিন্তু এই আঠা যদি মানুষের শরীরে ব্যবহার করা সম্ভব হয়, তবে হৃৎস্পন্দন বেশি হলেও তার সমস্যা হবে না।
কার্প মূলতঃ আইডিয়া পান মাকড়শার জাল থেকে। মাকড়শার জাল এতোটাই আঠালো হয় যে সেটা কোনও পৃষ্ঠের ওপরে পড়লে শক্ত হয়ে আটকে থাকে। একই সঙ্গে সেটা পানিরোধী। এইভাবেই তার বিশেষ আঠাটি তৈরি হয়। হৃৎপিণ্ডের ওপরে প্রয়োগ করে পাঁচ সেকেন্ড এর ওপর অতিবেগুনী রশ্মি ফেললে সেটা শক্ত হয়ে আটকে যায়। এই আঠা সব রকমের সরকারি এবং আইনি বিধিনিষেধ পার করে অনুমোদিত হলে হৃৎপিণ্ডের এমন ত্রুটি নিয়ে জন্ম নেওয়া মানুষেরা নিঃসন্দেহে অনেক ভালো উপকার পাবে।