বাতিঅলা বাতি বিক্রি করছে। তেলের কুপিবাতি। বিদ্যুতের ব্যবস্থা না থাকলে কিংবা ভেলকিবাজির মতো আচমকা বিদ্যুৎ চলে গেলে এ ধরনের বাতি ব্যবহার করা হয়। বাতিঅলার কাছে নানান ধরনের বাতি। একেকটা বাতির একেক ডিজাইন। একেক দাম। যার যেটি পছন্দ দাম দিয়ে কিনে নিতে পারে।
দুজন ক্রেতা এলেন বাতিঅলার কাছে। দুজনই মহিলা। এদের একজন উচ্চশিক্ষিতা, জ্ঞানী ও চাকুরে। তার স্বামীও চাকুরে। স্বামী-স্ত্রী দুজনের মিলিত আয় ও বুদ্ধির জোরে সংসার তাদের ভালো চলে। সংসার বলতে এক ছেলে এক মেয়ে। হিসাব করে চলেন। তাই কোনো সমস্যা হয় না।
অন্যজন গৃহিণী। স্বল্প শিক্ষিতা। একে তো শিক্ষাদীক্ষা কম তার উপর বুদ্ধিতেও প্রখর না। উনার স্বামী প্রবাসী। বিদেশে থাকেন। অনেক টাকা-পয়সা রোজগার করেন। স্বামীর উপার্জন তিনি ছেলেমেয়ে নিয়ে দুহাতে খরচ করেন। তবে সমস্যা হলো, তার খরচের খাতটা বরাবরই অনর্থ হয়। এতো টাকা খরচ করেন! কিন্তু খরচটা সঠিক খাতে হয় না। তাই তার সমস্যা কখনো দূর হয় না। সমস্যা লেগেই থাকে।
এই দুই মহিলা আবার পরস্পরের প্রতিবেশী। প্রায়ই তাদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হয়। কুশলবিনিময় হয়।
চাকুরে মহিলা বাতিঅলার কাছ থেকে দেখেশোনে দাম দিয়ে একটি টেকসই বাতি কিনে নিলেন। গৃহিণীও বাতি একটা কিনলেন। তবে তার বাতিটি যেমন স্বল্প দামি, তেমনি টেকসইও কম।
বাতিঅলার কাছ থেকে বাতি কিনে নিয়ে কিছুদূর গিয়ে গৃহিণী হঠাৎ থেমে গেলেন। তারপর চাকুরে মহিলাকে উদ্দেশ করে বললেন, আপা! শুধু শুধু এতো দাম দিয়ে বাতিটি কিনলেন। বাতি আমিও তো একটা কিনেছি। দেখুন না, অবিকল আপনার ওটার মতোই। তবে দাম কম। আপা আপনি ঠকেছেন।
গৃহিণীর কথা শুনে চাকুরে মহিলা বললেন, আমি আমার বুদ্ধিমতো কিনেছি। আপনিও আপনার বুদ্ধিমতোই কিনেছেন। তবে বাসায় নেওয়ার পর বোঝা যাবে কে জিতেছে। আপনি না, আমি।
বাসায় পেঁৗছে বাতিতে তেল ভরে দুজনই বাতি দুটি জ্বালালেন। দেখা গেল, বাতির আলোয় চাকুরে মহিলার মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কারণ তার কেনা বাতিটি উজ্জ্বল আলো নিয়ে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। আর গৃহিণীর মুখ একেবারে মলিন। কারণ তার কেনা বাতিটি ম্লান আলো নিয়ে মিটমিট করে জ্বলছে।
মহিলা দুজনের প্রত্যেকেরই আবার দুজন করে ছেলেমেয়ে। ছেলেমেয়ে স্কুলে পড়াশোনা করে। ছেলেমেয়ের পড়াশোনার কথা ভেবে দুজনের বাসাতেই দুজন গৃহশিক্ষক রাখলেন। শিক্ষক দুজন কলেজপড়ুয়া ছাত্র।
গৃহশিক্ষক যেদিন প্রথম গৃহিণীর বাসায় এলো, তিনি গৃহশিক্ষক সম্পর্কে কিছুই জানতে চাইলেন না। জানার কোনো আগ্রহই তার মাঝে দেখা গেল না। বরং সেদিনই তিনি অনেক দর কষাকষি করে গৃহশিক্ষকের জন্য একটি সম্মানী নির্ধারণ করে দিলেন।
আর চাকুরে মহিলার বাসায় যেদিন প্রথম গৃহশিক্ষক এলো, তিনি প্রথমে জানতে চাইলেন, রেজাল্ট কি?
জবাবে গৃহশিক্ষক বললো, সবগুলোই প্রথম শ্রেণী।
গৃহশিক্ষকের রেজাল্ট শুনে চাকুরে মহিলা খুব খুশি হলেন। বললেন, বাহ! চমৎকার তো! তিনি গৃহশিক্ষককে আরও কিছু খুঁটিনাটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন। জিজ্ঞেস করে গৃহশিক্ষক সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনে নিলেন। শেষে বললেন, এমন একজন শিক্ষকই তো আমাদের চাই। পরে তিনি কোনোরূপ দর কষাকষি না করে শিক্ষকের খুশিমতো একটি সম্মানী নির্ধারণ করে দিলেন।
চাকুরে মহিলার বাসায় গৃহিণী সেদিন বেড়াতে এসেছিলেন। শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে সব কথাই তিনি শুনেছিলেন। শেষে কৌতূহলী হয়ে গৃহিণী চাকুরে মহিলার কাছে জানতে চাইলেন, বিষয় কী আপা! গৃহশিক্ষক তো আপনিও রাখলেন।
আমিও রাখলাম। কিন্তু আপনি গৃহশিক্ষক সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে চাইলেন। সম্মানীটাও নির্ধারণ করে দিলেন শিক্ষকের খুশিমতো।
যা আমার চেয়ে বেশি। ঘটনা কি?
জবাবে চাকুরে মহিলা মৃদু হাসলেন। বললেন, ঘটনা সেই বাতি দুটোর মতোই।
গৃহিণী এবার আরও আগ্রহী হয়ে বললেন, ঠিক বুঝলাম না আপা। একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?
চাকুরে মহিলা এবার খুলে বললেন ঘটনা। বললেন, যে গৃহশিক্ষক আমার সন্তানকে পড়াবে, তার সম্পর্কে আগে আমার ভালোভাবে জানা দরকার। অভিভাবক হিসেবে সে অধিকার আমার আছে। তাই জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছি। ছেলেটা অসম্ভব মেধাবী প্রতিভাবান। ঠিক যেন আমার কেনা বাতিটির মতো। ছেলে যখন মেধাবী, সে বাতির মতোই আলোক বিলাতে পারবে। উজ্জ্বল জ্ঞানের আলোক।
যে আলোতে আমার ছেলেমেয়েও আলোকিত হয়ে উঠবে। আর যে আমার ছেলেমেয়েকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করবে, তার সাথে কোনোরূপ দর কষাকষি মানায় না। বলে চাকুরে মহিলাটি দম নিলেন।
গৃহিণী এতক্ষণ হা-করে চাকুরে মহিলার কথাবার্তা শুনছিলেন। শেষে কী বুঝে যেন বললেন, ও-আচ্ছা।